সাহিত্য শ্রবনিকা | শারদীয়া ১৪২৮






সম্পাদক ও প্রকাশক :- মানস রায়

সম্পাদকীয় দপ্তর : দিনহাটা, কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ 
পিন - ৭৩৬১৩৫
ইমেইল - srobonika@gmail.com
যোগাযোগ - ৮১১৬৬০৩৭৪০

প্রচ্ছদ - অভিষেক ঘোষ




শুরুর কলমে


জলমগ্ন দক্ষিণবঙ্গ, উত্তরের দোসর অজানা জ্বর, দুইয়ের গেরোয় শিউলি কাশের মরশুমেও কিছুটা মন ভার বঙ্গবাসীর । মহামারী কালীন পরিস্থিতিতে এবছরও দুর্গা পুজা প্রায় নিয়ম রক্ষার। উৎসবের জৌলুস ফিরে পাক তার পুরোনো রঙ এ আকাঙ্খা আমাদের প্রত্যেকেরই, যদিও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন প্যানডেমিক এখন এন্ডেমিকের পথে, ভাইরাসের নতুন প্রজাতি আর হয়ত মাথা তুলতে পারবে না আগের মতন। তবুও সামান্যতম গাফিলতিও মারাত্মক প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে আমাদের জন্য। সুতরাং একটা কথা স্পষ্ট ,করোনা বিধির ঘেরাটোপেই উদযাপিত হবে এবছরের শারদোৎসব। আগমনী আসে, দু মলাটের শারদ সংখ্যা এখন আর সীমাবদ্ধ থাকেনা দু মলাটেই , অনলাইন পত্র পত্রিকা গুলিও শারদ সম্ভারের ডালি সাজাচ্ছে অত্যন্ত যত্ন ও আতিথেয়তায়র সাথেই। সাহিত্য শ্রবণিকা ক্ষুদ্র পরিসরে চেষ্টা করেছে রুচি সম্মত লেখায় সংখ্যাটিকে সাজিয়ে তোলার। পড়ুন এবং পড়ান, উপভোগ করুন শারদ আনন্দ। সমস্ত ক্ষুদ্র পত্র পত্রিকা গুলোর পাশে থাকুন, চেষ্টা মতন বাড়িয়ে দিন সহযোগিতার হাত। শুভ শারদীয়া সব্বাইকে। 


এ সংখ্যায় লিখলেন যারা


• নিবন্ধ : আবীর ঘোষ

• মিনি উপন্যাস : তন্ময় দেব, তমাদিত্য ভট্টাচার্য

• কবিতা : শৈবাল মজুমদার, নীলাদ্রি দেব, অনিমেষ, নাদিরা, সৌরদীপ বর্দ্ধন, পলাশ দাস, অলোক আচার্য, তৈমুর খান, বেনজির হাবিবা, অমিত দত্ত

• ছড়া : মাথুর দাস, কিশোর কুমার দলুই

• গল্প : অপরজিতা পাল, সুব্রত দত্ত

• অণুগল্প : সোমনাথ বেনিয়া

• অঙ্কন : অন্তরা সূত্রধর 



নিবন্ধ


আসামের গৌরীপুর রাজবাড়ি ও রাজবংশের প্রাচীন দুর্গাপুজা

আবীর ঘোষ 



   অসমের গৌরীপুর রাজবাড়ির মা মহামায়া মন্দির

বর্তমান আসাম রাজ্যের গৌরীপুর রাজবংশের প্রথম যে পুরুষের নাম জানা যায় তিনি ছিলেন মঙ্কদাস নামক একজন ব্যক্তি । মঙ্কদাস ছিলেন গৌড় কায়স্থ , শূররাজার অধীনে উত্তর রাঢ়ে গঙ্গার ধারে তিনি বাস করতেন এবং সীমান্ত দেশের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তাঁর পুত্র টঙ্কপানি রাজা ধর্মপালের অনুগ্রহে তীরভুক্তির " প্রধান লেখ্য " বা " জ্যেষ্ঠ কায়স্থ " এর পদমর্যাদা লাভ করেন। তাঁর পুত্র - পৌত্রাদি দীর্ঘদিন মিথিলাতেই বসবাস করতেন।
এরপর মঙ্কদাসের ১১তম বংশধর শাক্তমতাম্বলি নরহরি রায় মুজফফরপুর থেকে দেবী কামাখ্যার দর্শনে প্রথমে আসামের কামাখ্যায় আসেন । তৎকালীন কামতাপুরের ( বর্তমান কুচবিহার ) " কোচ " রাজবংশের মহারাজা বিশ্বসিংহের ( রাজত্বকাল ১৪৯৬ - ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ ) গুরু সাবভৌম ভট্টাচার্যের অনুরোধে তিনি কোচ রাজ্যের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন এবং " বড়ুয়া " উপাধি পান। নরহরি রায়ের একপুত্র রামদাস মিথিলা রাজার অধীনেই থেকে গেলেন আর অপর পুত্র পয়োনিধি  পিতার সঙ্গে কামরূপেই বসবাস করতে থাকলেন। পয়োনিধির পুত্র কবিন্দ্রপাত্রকে কামতাপুরের ( কুচবিহার ) পরবর্তী মহারাজা নরনারায়ণ ( রাজত্বকাল ১৫৩৩ - ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ )  প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। পরবর্তীকালে মহারাজা নরনারায়ণের সাথে তাঁর ভাইপো কুমার রঘুদেব নারায়ণের মধ্যে রাজসিংহাসন দখলের লড়াই শুরু হলে কবীন্দ্র পাত্র অসমের রাঙামাটির দিকে চলে আসেন।


    অসমের গৌরীপুর রাজবাড়ির মা মহামায়া মন্দির

পরবর্তী কামতাপুরের ( কুচবিহার ) মহারাজা লক্ষীনারায়ণের বিরুদ্ধে সাহায্যের আবেদন চেয়ে মুঘল-সম্রাট জাহাঙ্গীরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কবীন্দ্র পাত্র । সেই সময়ই ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তিনি চার সরকারের ( সরকার কামরূপ , সরকার দক্ষিণকূল , সরকার ঢেকেরী ও সরকার বাঙ্গালভূম ) প্রথম " কানুনগোর " সনদ প্রাপ্ত হন। তিনি কার্যত  দিল্লীর বাদশাহের এবং নামেমাত্র ঢাকার নবাবের অধীনে ছিলেন। কবিন্দ্রপাত্র  ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন।
কবিন্দ্র পাত্রের ছয় পুত্রের মধ্যে কবিশেখর কুচবিহারের মহারাজা বীরনারায়ণের রাজত্বকালে বিশেষ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সনদের বলে পরবর্তী কানুনগো পদ লাভ করেন । বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁকে রাজা উপাধি দেন এবং তার সঙ্গে পাঞ্জা। কবিন্দ্র পাত্রের সময় থেকে আসামের রাঙ্গামাটিই ছিলো এই বংশের প্রধান রাজধানী ও বাসস্থান। সেই সময় থেকে এই বংশ " রাঙ্গামাটির বড়ুয়া " রাজবংশ বলে পরিচিত লাভ করেন।
গৌরীপুর রাজবংশের দেবী মহামায়ার প্রতিষ্ঠার কাহিনী :-  
কথিত আছে যে , রাজা কবিশেখরের আমলে বর্তমান গৌরীপুর থেকে রাজধানী রাঙ্গামাটি ছিলো সাত মাইল দূরে পাহাড়ে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। সাধক কবিশেখর একদিন ভোরে গেছেন ব্রহ্মপুত্রের ধারে , হটাৎ তিনি দেখলেন পাহাড়ের আড়াল থেকে যেনো দু- দুটো সূর্য উঠেছে ; পূর্ব দিগন্তে আলোর ঝলকানি । আর একটি ষোড়শী কন্যা জলের উপর দিয়ে হেটে আসছেন । সাধক রাজার ভক্তিপ্লুত মন বলে উঠলো এ নিশ্চই কোনো দেবী।পথ ছেড়ে তিনি তাড়াতাড়ি পাশের একটি জঙ্গলে লুকিয়ে ফেললেন। যে পথটি তিনি ছেড়ে দিলেন সেই পথটি সোজা চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। সেখানে রয়েছে একটি গুহা যার নাম " বাঘমারা " । সাধক রাজা কবিশেখর দেখলেন , দেবী হেটে চলছেন গুহার দিকে , হটাৎ গুহা থেকে বেরিয়ে এলো একটি বাঘ। বাঘটি দেবীকে পিঠে চড়িয়ে খানিকটা ঘোরাফেরা করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। সাধকপ্রবর তখন নিশ্চিন্ত হলেন ইনিই তাঁর আরাধিতা দেবী মহামায়া। দেবীকে তিনি ব্রহ্মপুত্রে নামতে দেখে তিনিও জঙ্গল ছেড়ে দেবীর যাবার পথ জুড়ে শুয়ে পড়লেন। দেবী ধীর মৃদুস্বরে তাঁকে তিন - তিনবার পথ ছেড়ে দিতে বললেন। কিন্তু সাধক রাজা নির্বাক , নিশ্চল । তখন দেবী তাকে সাতবার লাথি মারলেন এবং দশভ স্বরে বললেন :- " তুমি সত্যি একজন খাঁটি ভক্ত। তোমাকে দেখা দিতেই আমি এসেছি। পরীক্ষা করেছি তোমাকে নানা ভাবে । সাতবার লাথি খেয়েও তুমি ধৈর্য হারাও নি। তাই তোমায় বর দিয়ে গেলাম - সাত পুরুষ ধরে আমি তোমার বংশে থাকবো , তা তোমরা বিধিমতে পুজো করো আর নাই করো । তারপর পুজো করলে অবশ্য থাকবো , নচেৎ নয় ।" তখন থেকেই দেবী মহামায়াই হলেন গৌরীপুর রাজবংশের কুলদেবী। সেই সময় অষ্টধাতুর ছোট দুর্গা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় , ইনিই মা মহামায়া নামে পরিচিত ; দেবীর সাথে পুত্র - কন্যারা নেই।
সেই সাধক রাজা কবিশেখরের অধঃস্তন সপ্তম পুরুষ হলেন রাজা প্রতাপচন্দ্র বড়ুয়া ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী রাঙ্গামাটি থেকে বর্তমান গৌরীপুরে স্থানান্তরিত করেন  । সেই সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয় মহামায়া মন্দির। এই মহামায়া মন্দির থেকে পূজোর সময় ওই  ধাতব মূর্তিটিকে গৌরীপুর মহামায়া খেলার মাঠে মন্দির স্থাপন করে দুর্গা পূজা করা হয়, কিন্তু পূজো হয় অসম তথা গোয়ালপারার পরম্পরার সাথে মিশে থাকা শোলা দিয়ে তৈরি আরেকটি দুর্গা প্রতিমাকে । রাজা প্রতাপচন্দ্র খুব জাঁকজমক করে দুর্গা পুজো করতেন। দুই স্থানে পাঠা , কবুতর বলি দিয়ে পুজো করা হতো।
মহালয়ার দেবী পক্ষের প্রতিপদে দেবী মহামায়া আসেন নিজের বাড়ি। অর্থাৎ অসমের গৌরীপুরের রাজবাড়িতে। ১৫ দিন এই বাড়িতে থাকার পর লক্ষ্মী পূর্ণিমার পরের দিন প্রতিপদে ফিরে যান শ্বশুর বাড়ি। একই পারায় শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই পূজিতা হন সারা বছর।
১৯৭২ সালে উধাও হয়ে যায় অষ্টধাতুর মহামায়ার মূর্তিটি। সেই সময় গৌরীপুর জমিদারীর শেষ রাজা প্রকৃতীশ চন্দ্র বরুয়া (লালজি) বারাণসী থেকে এনেছিলেন আগের আদলে অষ্টধাতুর মা মহামায়া নতুন বিগ্রহ ।


অসমের গৌরীপুর রাজপরিবারে নিত্য পূজিতা অষ্টধাতুর দেবী মহামায়া 

গৌরীপুর রাজবাড়ির পুজোর সঙ্গে বলিরও একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় তাঁকে তুষ্ট করতে সারা বছর শনি আর মঙ্গলবার সপ্তাহে দু’দিন বলি হত। তবে আগে হত পাঁঠা বলি, আর এখন হয় পায়রা বলি। গৌরীপুর রাজবংশের বর্তমান সদস্য তথা শেষ রাজা প্রকৃতিশচন্দ্র বড়ুয়ার দ্বিতীয় পুত্র  প্রবীর বড়ুয়া জ্যেঠু আমায় জানিয়েছেন যে , “কলার খোলে জোড়া পায়রার রক্ত আর মাথা ধরে নেওয়া হয়। এর পর মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উৎসর্গ করা হয় দেবীকে।’’ বলি হয় পূজোর ক’দিনও।
পূজোর কদিন এখানে এক বিশেষ ধরনের ভোগের আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় গৌরীপুরে হয় ‘বিল্ববরণ’। সে দিনই বলি দেওয়া একটি সাদা পাঁঠা। কাছে গদাধর নদী। এদিন ৪ বার নিজের বাড়ি আর নদীর তীরে যাতায়াতের প্রয়োজন হয়। আগে বিল্ববরণে সামিল হত হাতির পাল। এখন শুধু পথযাত্রা।


গৌরীপুরের মাটিয়াবাগ প্রাসাদের সামনে অবস্থিত কামান যার সামনে বিজয়া দশমীর দিন রণচন্ডী পুজো করা হয়।

দেবীর বিসর্জন এখানে একটু অন্য ধরনের। দেবী দুর্গাকে গৌরীপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গদাধর নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গদাধর এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর সংগমস্থলীতে সাত পাঁক ঘুরিয়ে শোলার তৈরি প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিজয়াদশমীর পর ওই দিন কুলপ্রথা অনুযায়ী রণচণ্ডী পূজা এবং কামান পূজার আয়োজন করা হয়। পূজোকে ঘিরে যেন ফিরে আসে গৌরীপুরের রাজ বাড়ির সোনালী দিনের ঝলক। আজও সেই পূজো প্রাণবন্ত, তার ঐতিহ্য, রং আর প্রাণ নিয়ে।
রাজবাড়ির পুজোর ছবি গুলো দিয়ে আমায় সাহায্য করেছেন :- গৌরীপুর রাজবংশের কন্যা ও গোয়ালপরিয়া গানের বর্তমান জনপ্রিয় শিল্পী পুনম বড়ুয়া দিদি। 

তথ্যগুলি প্রাপ্ত :- " হাতির সঙ্গে পঞ্চাশ বছর " by পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য এবং এই রাজবংশের বর্তমান রাজকুমার প্রবীর বড়ুয়া জেঠুর কাছ থেকে।



মিনি উপন্যাস


বৃষ্টি শেষে রোদ

তন্ময় দেব




১. মায়াবী বসন্ত

‘এখনকার ছেলেমেয়েরা কত ডেসপারেট তাই না?’ – বিশ্বরূপ কাশ্মীরি শালটায় ভালো করে শরীর ঢেকে নিয়ে বললেন।
বাইরে হালকা হালকা তুষারবৃষ্টি হচ্ছে, তুলিকা সেইদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বিশ্বরূপ বুঝলেন তার কথা তুলিকার কানে যায়নি।
জানুয়ারি মাসে মানালিতে উষ্ণতা মাইনাসে নেমে আসে, বরফ পরে। বিশ্বরূপের ছোটো থেকে ঠাণ্ডার দোষ। বারবার না করেছিলেন আসবেন না, বয়স বাড়ছে এখন, অল্পতেই শরীরের কল-কব্জাগুলো বিগড়ে যায়। তুলিকাও না করেছিল কিন্তু তরুণ রক্তের সামনে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই দুজনের ‘না’ ধোপে টিকবে কেন? অতএব আসতেই হল।
দোতালার এই ব্যালকনি থেকে অনতিদূরে একটা নাম না জানা পাহাড়, কুয়াশার মতো মেঘ সেখানে ধাক্কা খেয়ে বিশ্বরূপদের দিকে ধেয়ে আসছে।
অদ্ভুত আবছা এই পরিবেশের মাঝে চোখে রিমলেস চশমা, উঁকি দেওয়া চার-পাঁচটা পাকা চুল আর মেরুন রঙের সোয়েটারে তুলিকাকে মায়াবী বসন্ত মনে হল বিশ্বরূপের।
কাছেই কোথাও হয়তো কোনো পাহাড়ি ফুল ফুটেছে, একটা মনকেমন করা গন্ধ ছুটে এসে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে অনুভূতিতে।
তুলিকা ঠিকই বলে, সব নিয়তি, মানুষ নিমিত্ত মাত্র। ছোট্ট হলেও কি গভীর কথাটা! 
নাহলে এমন একটা মুহূর্তের জন্য কি কুড়ি বছর অপেক্ষা করতে হয়!

বিশ্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

২. প্রাচীর ভাঙার অবকাশে

এতসব ভাবনার ভিড়ে বিশ্বরূপ দেখলেন তুলিকা এখনও গহীন দৃষ্টিতে প্রকৃতির মনের কথা পড়ে নিতে চাইছে, যেভাবে বিশ্বরূপের সব কষ্ট-দুঃখ-অভিমান পড়ে ফেলে এক নিমেষে।
মেঘের আনাগোনা আরেকটু বেড়ে গেলো যেন। হুহু করে বাতাস ঢুকছে, তুলিকা একটু কেঁপে উঠলেন। তা দেখে বিশ্বরূপ খানিকটা এগিয়ে বেতের মোড়াটা টেনে পাশে বসে শাল দিয়ে মুড়ে নিলেন তুলিকাকে।
আকস্মিক বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে তুলিকা ‘ধ্যাৎ!’ বলে লজ্জায় মুখ লুকোলেন বিশ্বরূপের বুকে।

বিশ্বরূপ অনুযোগের সুরে বললেন, ‘এভাবে ঠাণ্ডা লাগাচ্ছ কেন? এরপর জ্বর এলে কি হবে? কোনোদিনই তোমার ভেতরে নিজের খেয়াল রাখার তাগিদ দেখলাম না’
বিশ্বরূপের বুকের কাছে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে তুলিকা বললেন, ‘এখন আমি আর ষোড়শী নই আর তুমিও সেই সদ্য গোঁফ ওঠা তরুণ নও যে সময় সুযোগ পেলেই আমার বাড়ির সামনে গিয়ে হত্যে দিত’
‘আমি মোটেও হত্যে দিতাম না’ – বিশ্বরূপ যেন খানিকটা লজ্জা পেলেন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা ধরে রেখে বললেন, ‘অত সুন্দর চাঁদপানা মুখের টান এড়ানো খুব কঠিন তুলি। ছেলে হলে বুঝতে কত জ্বালা!’
– ‘বাহ! এই না হলে প্রেম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এক কম্বলের নীচে’ গল্প পড়েছিলাম, এখানে ‘এক চাদরের নীচে’! ভালো প্লট পাওয়া গেলো আমার পরবর্তী গল্পের জন্য’ টিপ্পনীটা কানে আসতেই লজ্জায় নুইয়ে গেলেন তুলিকা-বিশ্বরূপ। স্বভাবতই দুজনে একটু সরে বসলেন।
- ‘আরে! আরে! সরলে কেন? ওভাবেই বসো। একটা ছবি তুলে রাখি’
তুলিকা এবার বললেন, ‘বড্ড অসভ্য হয়েছিস ঝুমুর। এরপর কান মুলে দেবো যখন তখন মজা টের পাবি!’
- ‘সত্য বলার জন্য গ্যালিলিও মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিল। আমি নাহয় কানমুলোই পেলাম’ হাসতে হাসতে বলল ঝুমুর। পাশে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে ছিল। ওর উড বি হাজবেন্ড।
সকলেই ঝুমুরের কোথায় হেসে উঠল।
তুলিকা আর বিশ্বরূপ জানে, ঝুমুর-অনির্বাণ না থাকলে ওনাদের দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠা সুদীর্ঘ প্রাচীর এই জন্মে ভাঙত না!

৩. বিশ্বরূপের কথা

বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। এবার না বেরোতে পারলে বাড়ি ফেরা যাবে না। মা বলেছিল বারবার করে অথচ বেরোবার সময় ছাতাটা ব্যাগে পুরতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল বিশ্বরূপ।
আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের উজ্জ্বলতম ছাত্র বিশ্বরূপের এসব পার্থিব ব্যাপারে ভুলোমনা হিসেবে পরিবার ও আত্মীয় সমাজে বদনাম আছে। বাবার টর্চ, সংসারের খরচখাতা, বাজার করতে গিয়ে দরকারি জিনিস আনতে ভুলে যাওয়া এসব বিশ্বরূপের নিত্যদিনের ব্যাপার।
তবে পড়াশোনার প্রতি ওর অমনোযোগের ঘটনা আজ অবধি কেউ দেখেনি। সে নিজের খেয়ালে থাকে, ছবি আঁকে পড়াশোনার ফাঁকে। বন্ধুদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে বন্যার সময় ত্রান বিলি করে আসে দুর্গতদের। হইহই করে নেমে পড়ে মাঠে ফুটবল খেলতে।
বাড়ির লোক যখন শুনল এমন ছেলে প্রেমে পড়েছে, তখন সবাই ভ্যাবাচাকা খেয়েছিল বৈকি!
বিশ্বরূপের দাদা অভিরূপ বাড়িতে এসে খবর দিল তার ছোটভাইকে একটি মেয়ের সঙ্গে হেঁটে বেড়াতে দেখেছে। তারপর একদিন বিশ্বরূপের বাবাও দেখলেন। বিশ্বরূপকে জিজ্ঞেস করলে সচরাচর ও এড়িয়েই যেত কিন্তু সেদিন বিশ্বরূপ যখন ভিজে একসা হয়ে বাড়ি ফিরতে সবাই জিজ্ঞেস করলো, ‘মেয়েটি কে?’, বিশ্বরূপ শুধু বলেছিল, ‘আমার বন্ধু!’, তারপর নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে।


৪. তুলিকার কথা

যারা বৃষ্টিতে ভিজেছে তারা জানে চোখের দৃষ্টি কিভাবে ঝাপসা হয়ে আসে। তুলিকারও এসেছিল। কিন্তু তুলিকা এও জানে ও যা করেছে ঠিক করেছে। ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ছোট দু’বোনকে মানুষ করতে হবে। তুলিকার মা মারা গেছেন ছোটবেলাতে। বাবার গালামাল দোকান। আর অন্যদিকে বিশ্বরূপের বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন। বিশ্বরূপের সঙ্গে পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোনদিকেই খাপ খায় না তুলিকার।
পাশাপাশি কখনোই বিশ্বরূপকে প্রেমিক হিসেবে দেখেনি তুলিকা। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলেটিকে ফেরাতেও মন চায়নি।
‘আমি কি তবে বিশ্বরূপকে মনে মনে...’ – তুলিকা বারবার প্রশ্নটা করেছে নিজেকে প্রতিদিন। কোন উত্তর খুঁজে পায়নি। তারপর ভেবে নিয়েছে ভালবাসায় প্রশ্নের কোনো জায়গা নেই। ওকে টিউশন পড়াতে আসা সুভাষ দা’র বিষয়ে তো কখনও এমন প্রশ্ন জাগেনি ওর মনে।
তুলিকা সুভাষদা কে মনের কথা বলতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ভালোবাসার বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না ওর মনে। এদিকে তিন বছরের পরিচয় ও বন্ধুত্বে বিশ্বরূপের ব্যাপারে তেমন কিছু অনুভব করেনি তুলিকা। সুতরাং, এটা ভালোবাসা নয়... হতেই পারে না। কিন্তু আজ যখন বিশ্বরূপ জানিয়েছিল মাস্টার্স করার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, তুলিকার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল কেন তবে?
বিশ্বরূপ বলেছিল, তুলিকা তুই চাইলে আমি ক্যালিফোর্নিয়া যাবো না। তোর সঙ্গে জীবন কাটাতে চাই। আমার যা রেজাল্ট আছে, এখানে মাস্টার্স করার পর হামেশায় হাইস্কুলের চাকরি জুটে যাবে। তুই একবার বল যে যাস না রূপ... একবার বল।
নাহ! তুলিকা বলতে পারেনি। ও তো বিশ্বরূপকে ভালোবাসে না, বন্ধু ভাবে। একতরফা ভালোবাসা হয় না। রূপ কথাটা একবারও বুঝতে চায়নি এতদিন, আজও বুঝবে না। প্রিয় বন্ধুকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য যোগাযোগ বন্ধ করেনি কিন্তু আজ আর নয়।
সজোরে নেমে আসা বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গেল তুলিকার চিৎকার,
‘তোকে আমি ভালোবাসি না রূপ। তুই কেন বুঝছিস না? আমি তোকে বন্ধু ভেবে এসেছি... শুধুমাত্র বন্ধু’
তুলিকা দেখল বিশ্বরূপ একটা কথাও বলল না। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়ল। হয়তো চোখের জল ঢাকার জন্য। তুলিকা স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বৃষ্টির মধ্যে।
পথের বাঁকে বিশ্বরূপের চেহারাটা মিলিয়ে যেতেই তুলিকার ঝাপসা দৃষ্টি ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে গেল। মাথা ঠিক রাখতে না পেরে ও ধপাস করে বসে পড়ল মাঝরাস্তায়। 
তুলিকা কি তবে... নাহলে এভাবে ওর বুকের ভেতর থেকে চিৎকার বেরিয়ে এলো কেন... ও কি একটা বড় ভুল করে ফেলল তবে...

৫. নিশ্চুপ টাইমলাইন ও ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট

ঝুমুরের একটানা আবদারে অবশেষে ফেসবুকে না এসে পারলেন না তুলিকা।
‘শহরের নামী স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড ম্যাডামের ফেসবুক নেই, এটা ঠিক মানা যায় না!’, ঝুমুর বলেছিল। তুলিকাও দেখলেন ওনার কলিগ থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন প্রত্যেকেরই সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে।
তাই ২০১৫ তে দাঁড়িয়ে নিজের অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকা সত্ত্বেও ফেসবুক না খোলার কোন কারণ দেখতে পেলেন না তুলিকা। ঝুমুর এখন বড় হয়ে গেছে। কলেজে পড়ে। সারাদিন স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে বেশ একটা অখণ্ড অবসর সময় পড়ে থাকে তুলিকার জন্য। সেই সময়ের কিছুটা ফেসবুকে ব্যয় করলে খুব একটা কিছু যায় আসবে না।
ঝুমুরই খুলে দিয়েছিল অ্যাকাউন্ট। ফোন নাম্বার, ইমেইল, ছবি, শিক্ষা, চাকরি – যেন ফর্ম ফিলাপ!
ঝুমুর বিজ্ঞের মতো বলেছিল, লোকে যাতে ফেক না ভাবে তোমাকে তাই এত কিছু দিতে হচ্ছে। নাহলে এমন হাজারো তুলিকা বসু ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। তুলিকা নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এতদিন তিনি ভেবে এসেছেন তুলিকা নামটা কেমন যেন ব্যাকডেটেড কিন্তু নতুন যুগের মেয়েদেরও এই নাম রাখা হচ্ছে দেখে তুলিকা ভেতরে ভেতরে বেশ প্রশান্তি অনুভব করলেন। অনুভব করলেন ফেসবুক দুনিয়া টানছে তাকেও।
ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজন, স্কুল কলেজের বন্ধু-বান্ধবীসহ বিভিন্ন মানুষের ভিড় জমতে শুরু করলো তুলিকার অ্যাকাউন্টে। তাদের ছেলেমেয়ে, পরিবারের ছবিতে লাইক কমেন্টে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলেন তুলিকা। নিজেও ঘুরতে গিয়ে ঝুমুরের সাথে তোলা কিছু ছবি পোস্ট করলেন। বেশ দারুণ সময় কাটতে লাগল নতুন জগতে।
তুলিকা সচরাচর রাত বারোটায় শুয়ে পড়েন। ঘুমোনোর আগে স্ক্রোলিং করা অভ্যেস হয়ে উঠেছে। তাইই করছিলেন, হঠাৎ পিংপিং শব্দে চার-পাঁচখানা নোটিফিকেশন এলো। দেখলেন, কলেজের বন্ধুরা মিলে একটা ফেসবুক গ্রুপ খুলেছে, তাতে তুলিকা কেও অ্যাড করা হয়েছে যথারীতি। মেম্বার লিস্ট চেক করতে করতে একটা নামে চোখ আটকে গেল তুলিকার। তিনি বুঝলেন চোখের পাতায় জুড়ে আসা ঘুমটা আর নেই। উন্মাদনা খেলে বেড়াচ্ছে বুকের ভেতর, এতদিন বাদেও। ইত্যবসরে একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও ঢুকল। তুলিকা না দেখেও বেশ বুঝতে পেরেছেন, ব্যক্তিটি কে।

৬. ঝুমুরের কথা

হ্যালো! আমি ঝুমুর। তন্ময় দার মুখ থেকে মোটামুটি বেসিকটা শুনেই নিয়েছেন। বাকিটা আমি বলছি, কি করে অসাধ্য সাধন করলাম। তা তন্ময় দা একটা ভারত রত্ন পাওয়া যাবে এমন একটা ভালো কাজের জন্য? হাহাহা... যাই হোক এবার কাহিনীতে ফেরা যাক।
২০১৫ নাগাদ মাম্মামকে আমি ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। আপনাদের তুলিকা ম্যাডামকে আমি মাম্মাম ডাকি। সম্পর্কে উনি আমার মাসি হন। তন্ময়দা এমন ঘুরিয়ে লিখেছেন যে আপনাদের মনে হয়েছে আমি ওনার মেয়ে, তাই না? হ্যাটস অফ! সাধেই কি হত্যে দিয়ে পরে আছি এমন সম্পাদকের পেছনে। আমার মতো শিক্ষানবিস অক্ষরজীবীর যে অনেক কিছু শেখা বাকি এখনও।
ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি মাম্মা খুবই পাঞ্চুয়াল, বারোটায় ঘুমোন, সকাল সাড়ে ছটায় ওঠেন। আমি রাত জাগি দেখে এককালে প্রচুর বকা খেতে হয়েছে। তো মাম্মাম প্রথম প্রথম ফেসবুকে বিশেষ অ্যাক্টিভ ছিলেন না কিন্তু কয়েক মাস পর থেকে দেখলাম বেশ রাত অবধি সবুজ বাতি জ্বলছে তুলিকা বসুর নামে। প্রথম প্রথম আমল দিইনি বিশেষ, কিন্তু ঘটনাটা এরপর নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠল এবং লেডি শার্লক মানে আমি আসরে নামলাম! সঙ্গী হল অনির্বান, আমার তখনকার প্রেমিক, এখন ফিয়ান্সে! এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, অনির্বাণের প্রেমিক সত্ত্বা লোপ পেয়েছে, ঠিক যেদিন দুজনের বাড়ির লোকই আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছিল সেদিন থেকে!

অনেক খোঁজ লাগালাম দুজনে। কোথাও কোন গলদ নেই। বাড়ি, পরিবার, স্কুল সবকিছুর দায়িত্ব একই ভাবে সামলাচ্ছেন যেভাবে সামলে এসেছেন এতদিন কিন্তু  তারপরেও তুলিকা বসু রাত জাগছেন, প্রতিদিন!
এভাবে এক বছর কেটে গেল। একদিন আমি আর অনির্বাণ ঠিক করলাম, এবার অ্যাকাউন্ট চেক করা ছাড়া কোন উপায় নেই। হ্যাকের প্ল্যান যে মাথায় স্ট্রাইক করেনি সেটা অস্বীকার করছি না, আরেকবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করে দেখি, পারিনি। আমার বেস্টফ্রেন্ড বলতে মাম্মামই কিন্তু তারপরেও উনি জানেন কিভাবে ব্যক্তিগত জীবনকে আড়ালে রাখতে হয়, সেখানে প্রবেশের এক্তিয়ার কারোর নেই। অতএব একমাত্র উপায় দিদুন। দিদুন কোচবিহারে থাকেন, আমার ছোটমাসির কাছে। ওনাকে ফোন করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাম্মাম বিয়ে করেনি কেন?’
বেশ খানিকক্ষণ আলোচনার পর উত্তরে একটা নাম বেরিয়ে এলো, বিশ্বরূপ রায়!

৭. প্রাচীর ভেঙে ভেঙে যায়

অনুভূতি এমন একটা জিনিস, দুঃখের হোক কিংবা সুখের, শেয়ার না করলে ঠিক স্বাদ পাওয়া যায় না। মার্ক জুকারবার্গ এই সত্যটুকু খুব ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই আজ বিশ্বের কনিষ্ঠতম বিলিওনিয়ার।
কার জীবনে কি চলছে, কে কোথায় যাচ্ছে, কি পছন্দ, কি অপছন্দ – সবটাই নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিটির ফেসবুক ওয়াল চেক করলেই জানা যায়। এবার অনেকে দাবি করেন তারা ব্যক্তিগত জীবন সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে পছন্দ করেন না কিন্তু ওই যে শুরুতেই বললাম, অনুভূতি এমন একখানা জিনিস, ভাগাভাগিতে যার মূল্য বাড়ে। 
তবে তুলিকা সবার চেয়ে আলাদা। তিনি এই হাতছানির দিকে পা বাড়াননি, তাই তুলিকার ফেসবুক টাইমলাইন ঘুরেও কিচ্ছু আঁচ করতে পারেনি ঝুমুর অ্যান্ড কোং!
কিন্তু বিশ্বরূপ কি নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন? নাহ! অতটা কাঠিন্য বিশ্বরূপের চরিত্রে নেই। দিদুনের থেকে নামটা জানার পর ঝুমুর তাই ওর ভাষায় ‘চাপ্পা চাপ্পা’ করে খুঁজে ফেলেছিল বিশ্বরূপ রায়ের অ্যাকাউন্ট, প্রথম প্রথম ফল মেলেনি কিছু, হয়তো তুলিকারই নির্দেশ হবে, কিন্তু বিশ্বরূপ রায় বেশিদিন অনুভূতির বাঁধ চেপে রাখতে পারলেন না, ২০১৭ –র ২৫শে ডিসেম্বর দার্জিলিং ম্যালে তুলিকার সঙ্গে তোলা একখানা ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দিলেন, ‘বৃষ্টি শেষে!’
ব্যাস! ধসে পড়ল সমস্ত প্রাচীর। ঝুমুর বিশ্বরূপকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল দিদুনের কাছে নামটা জানামাত্রই, তবে বিশ্বরূপও হয়ত ওর ব্যাপারে জানতেন আর তাই রিকুয়েস্টও অ্যাক্সেপ্ট করেছিলেন। তাহলে কি ইচ্ছে করেই শেয়ার করেছেন ছবিটা, যাতে ঝুমুরও কিছু আঁচ করতে পারে। কারণ মাম্মাম ওকে বলে গিয়েছিল ছাত্রীদের নিয়ে এক্সকারশনে যাচ্ছেন ওরা বাঁকুড়া থেকে দার্জিলিং।
ঝুমুর স্পষ্ট বুঝতে পারল, যাত্রার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র শিক্ষামূলক ভ্রমণই নয়। এরপর ও আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে, ফেসবুক হোক কিংবা বাস্তব জীবন, একটাই শর্ত, অনুভূতি ভাগবাটোয়ারার জিনিস।
তুলিকা ফিরতেই ঝুমুর আর অনির্বাণ দুজনে চেপে ধরল। তারপর একে একে বেরিয়ে এলো অতীত বর্তমানের সব কথা। বিশ্বরূপের ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাওয়া, তুলিকার নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারানোর আফসোস, ভেতরে ভেতরে বিশ্বরূপকে অজান্তে ভালোবেসে ফেলা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, স্কুলে চাকরি, দু’বোনকে মানুষ করা, মেজোবোন আর বোনজামাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টের মৃত্যুর পর ঝুমুরকে আঁকড়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া।

তারপর সেই ঝুমুরের সৌজন্যেই ফেসবুকে ফিরে পাওয়া বিশ্বরূপকে। তখন সে আর রূপ নেই, দিল্লি ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স প্রফেসর বিশ্বরূপ রায়। তুলিকা প্রথমে কি বলবেন বুঝতে পারেননি কিন্তু অজস্র কথা জমে ছিল ভেতরে। বিশ্বরূপই আইস ব্রেক করেছিল, ‘কভার ফটোতে ও কি তোমার মেয়ে?’

তুলিকা শুরুতেই বেহায়ার মতো বলে দিয়েছিলেন, ‘তুমিটা বড্ড কানে লাগছে তবে আমাদের যা বয়স তুমিই ঠিক আছে, আপনি বললে একদম মানাতো না আর ছবিতে ও আমার মেয়েই, শুধু গর্ভে ধরিনি এই যা’, তারপর বলে ফেলেছিল, ‘আমি বিয়ে করিনি রূপ। তুমি?’
কেন বলেছিল বিয়ের কথা তুলিকা জানেন না, কেমন আছো, কি করছ, সব কেমন চলছে, সাধারণত মানুষ এসবই জিজ্ঞেস করে দীর্ঘদিন বাদে দেখা হলে, কিন্তু তুলিকা সেসব ধারও ধারেননি। হয়তো অজান্তেই জানতে চেয়েছিলেন বিশ্বরূপের ব্যক্তিগত জীবনের খবর।

বিশ্বরূপ কিন্তু প্রথমে উত্তর দেননি, সব কুশল সংবাদ জেনে নেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘আমি এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছিলাম, তোমাকে ভুলতেই হয়তো, কিন্তু বেশিদিন টেকেনি, দেড় বছরের মাথায় ছাড়াছাড়ি, সেও নাকি আরেকজনকে ভুলতে আমায় বিয়ে করেছিল। এই তো জীবন। তারপর থেকে একাই আছি, বেশ কেটে যাচ্ছে সময়। রিসার্চের কাজ, পড়ানো, আর ফটোগ্রাফি নিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে’

তারপর আরও টুকটাক কিছু কথা শেষে প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘আমি কিছুদিনের জন্য কোচবিহার যাচ্ছি নেক্সট উইক। বাড়িতে মা অসুস্থ। আসবে নাকি এরমধ্যে এদিকে?’

তুলিকারও অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি, ঝুমুরের কলেজ খোলা, চাইলেও যেতে পারবে না। এই সুযোগে তিনিও ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন কোচবিহার। সেই শুরু...


৮. বৃষ্টি শেষে রোদ

এরপর দুবছর কেটে গেছে। অনির্বাণ চাকরিটা হয়ে যেতেই দু’বাড়ি থেকে ওদের বাগদান পর্ব সারা হয়ে গেল। তারপরই এই সিমলা ট্যুর।

ঠাণ্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে সঙ্গে বৃষ্টি লেগে আছে দিনভর, হোটেল থেকে বেরনোই যাচ্ছিল না। বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা ঝমঝম থেকে ঝিরিঝিরি হতেই চারজন ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কাঁহাতক আর বসে থাকা যায়।

কালের নিয়ম মেনে, নবীন যুগল নতুন উদ্যমে আগে আগে হেঁটে চলেছে, প্রবীণেরা পিছু পিছু। কুয়াশা কাটছে ধীরে ধীরে। এদিকটা বেশ নির্জন, মাঝে মাঝে টুরিস্ট গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে নেমে যাচ্ছে সমতলের দিকে। রাস্তার একপাশে খাদ, তারপর আরেকটি পাহাড়ের শুরু। অসাধারন সৌন্দর্য বিরাজ করছে চারপাশে।

বিশ্বরূপ হাঁটতে হাঁটতে আলতো করে চেপে ধরলেন তুলিকার হাত। তুলিকা স্বভাবতই লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিলেন মাটির দিকে। ভাবনা ভিড় করে এলো। গত আড়াই বছরে বিশ্বরূপের কাছে বহুবার ক্ষমা চেয়েছেন বৃষ্টিভেজা দিনের শেষ দেখাটায় ওভাবে ব্যবহার করার জন্য, বিশ্বরূপ প্রতিবার ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন এসব আর মাথায় না আনতে, তুলিকা পারেননি। আজও তাই আবার বললেন, ‘রূপ তোমাকে যে ভেতরে ভেতরে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন তুমি চলে গেলে, আর ফিরে আসার কোন সুযোগ রইল না তখন আমি মাঝরাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিলাম। বৃষ্টির একেকটি ফোঁটা আমাকে জানান দিচ্ছিল তোমার অনুপস্থিতি, শূন্যতার কথা’
বিশ্বরূপ গভীর ভাবে তুলিকার হাতটাকে নিজের হাতের মধ্যে নিলেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বললেন, ‘তুমি বড্ড বেশি ভাব। এসো, এগোই। ওরা অনেক দূর হেঁটে চলে গেছে’
রাস্তার বাঁক ঘুরতেই যথারীতি ঝুমুর-অনির্বাণকে দেখা গেল। ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে মেঘে ছোঁয়া যায়। অজানা নদী বয়ে চলেছে নীচে। স্রোতের আওয়াজ ভেসে আসছে এত উঁচুতেও।
ঝুমুর বলল, ‘মাম্মাম তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। চোখ বোজো দেখি’
তুলিকা জানেন ঝুমুরের স্বভাব। কি থেকে কি করবে কোন ইয়ত্তা নেই। উনি তাই চোখ বুজতে চাইলেন না কিন্তু ঝুমুর কবে শুনেছে সেসব, অগত্যা বুজতেই হল।
খানিক বাদে ঝুমুর বলল, ‘চোখ খোলো এবার!’
চোখ খুলতেই তুলিকা দেখলেন, বিশ্বরূপ হাতে একখানা প্ল্যাটিনামের রিং ধরে হাঁটু মুড়ে বসেছেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘সেদিনও এক বৃষ্টির দিনে তোমার থেকে দূরে যেতে হয়েছিল, আজও তেমনি এক বৃষ্টিদিন। আজ কিন্তু আর খালি হাতে ফেরত যেতে চাইনা তুলি... বিয়ে করবে আমাকে?’
তুলিকা বুঝতে পারলেন না কি বলবেন, শুধু অনুভব করলেন বৃষ্টিফোঁটাগুলোতে আজ আর শূন্যতা নেই, বড্ড আন্তরিকতা লেগে আছে। সেদিনের সদ্য যৌবনে পা দেওয়া রূপ আর আজকের চুলে সামান্য পাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়িতে সামনে উপস্থিত বিশ্বরূপের মধ্যে কোন ফারাক তিনি করতে পারলেন না। 
ঝুমুর অনির্বাণ পাশ থেকে কি বলছে সেসবও কানে ঢুকছে না। তুলিকা শুধু এটুকু বুঝতে পারছেন এবার সমস্ত বৃষ্টি বিদায় নিয়ে রোদ উঠবে পাহাড়ের কোলে, জীবনে আর ভালোবাসার আকাশে।



মিনি উপন্যাস

মিসড্ কল

তমাদিত্য ভট্টাচার্য্য





এক

বছরের এই চারটি দিন ছুটিতে থাকেন মহীন বাবু । বাকি বাঙালি অধ্যাপকেরাও বেশির ভাগ ছুটিতেই থাকেন এই সময় । আর পাঁচজন অন্তর্দেশীয় প্রবাসী বাঙালীদের মতো ব্যাগপত্র গুছিয়ে বঙ্গযাত্রার রাস্তা ধরেন না তিনি । বরং আবাসনেই বেশ গুরুপাকযুক্ত বাঙালি রান্না, বাজার-হাট, ঘরে টুকটাক কাজকর্ম, প্রিয় সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাস, আর তারপরেও সময় বাঁচলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও তার বাইরে সপরিবারে প্রবাসী বাঙালিদের পুজোমন্ডপে খানিকটা সময় কাটানো…এই হল মহীনবাবুর পুজোর রুটিন । এই নিয়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিস্তর দ্বন্দ্ব ।
 পুজোর দিনগুলি ছাড়াও বাবার রোজকার রুটিন রতনের কাছে একঘেয়ে লাগে । যদিও শাসনের অধিকারটুকু বাদ দিলে দেবস্মিতা ও মহীন বাবুর সম্পর্ক আর পাঁচটা বাঙালি ঘরের বাবা ও মেয়ের সম্পর্কের মতোই যথেষ্ট সংবেদনশীল ।
  পুজো মণ্ডপে গিয়ে গিয়ে কিংবা রাস্তায় নেমে পুজো উপভোগ করা সেদিন থেকেই মহীনবাবুর জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে যেদিন তিনিও নিজের জন্মভিটে ছেড়ে পাকাপাকিভাবে পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে ।
  শৈশব কৈশোর কেটেছে উত্তরবঙ্গের ফালাকাটায় । মহিন বাবুর দুর্গাপুজো কেটে যেত ডুয়ার্সের তিন-তিনটে জেলার পুজোয় বিচরণ করে । প্রত্যন্ত ডুয়ার্স বলতে যা বোঝায় সেখানেই ছোট থেকে একসাথে বেড়ে উঠেছেন মহিন বাবু ও তার বাল্য বয়সের সঙ্গী বাণীব্রত ।
  মাসখানেক আগে থেকেই দুই বন্ধুর প্রস্তুতি থাকতো তুঙ্গে । আলিপুরদুয়ার থেকে পুজোর কেনাকাটা, মূর্তি বা প্যান্ডেল তৈরি হতে শুরু করার পর থেকেই কুমোরটুলি বা ক্লাবগুলোতে যখন তখন একসাথে ঘুরঘুর করা, নিম্নচাপের বৃষ্টিপাতের ভয়ে ঘনঘন আবহাওয়ার খবর দেখা ও আকাশের দিকে নজর রাখা; এসব কালক্রমে পুনেতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করার পর থেকে ও সময়ের স্রোতে জীবন ভাসিয়ে হয়তো হারিয়ে ফেলেছেন নয়তো বিস্মৃত হয়েছেন ।
   এখানে প্রকৃতি বড় উদার । শরৎ আসতে না আসতেই নিম্নচাপ বর্ষাকাল মেঘ সব পাততাড়ি গুটিয়ে উধাও হয়ে পড়ে । পুজোর মরসুমের সেই বুক ধুকপুক ব্যাপারটাই নেই ।
   আবাসন বা ক্যাম্পাস থেকে দুই পা এগোলেই জমকালো চারটে প্রবাসী পুজো চোখে পড়ে । 
   উর্মি দেবীর ছেলেবেলা কেটেছে তপসীখাতায় ।
   বাবা অন্তপ্রাণ মহিন বাবু বাবা-মায়ের পছন্দমত মফস্বলের মেয়েকেই বিয়ে করে পুনে নিয়ে আসেন ।
   প্রথম প্রথম বেশ মনখারাপ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উর্মি দেবী প্রবাসের পূজার সঙ্গে ধীরে ধীরে একাত্ম হয়ে উঠেছেন কিন্তু মহিন বাবুকে নিয়ে বেরোতে চাইলেই বাজখাই কন্ঠে তিনি বলে ওঠেন,“ওসব প্রবাসের পুজো প্রবাসের মতই হয় । নিজের শহরের পুজো কি আর বাইরে পাওয়া যায় ।”
   এত বছর ধরে এসব শুনে অভ্যস্ত উর্মি দেবী তাই এখন মহিন বাবুর তোয়াক্কা না করে ছেলে-মেয়েকে নিয়েই বেরিয়ে পড়েন ।
   রতন বা দেবস্মিতা কখনো বাবার ছেলেবেলার রাস্তাগুলোর ধারকাছ দিয়েও যায়নি । ওদের কাছে ছোটবেলা বড়বেলা সবটুকুই প্রবাস ।

দুই

   আইআইএসইআর ক্যাম্পাসের পিছন গেট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে ডানদিকে গেলেই পাষাণ বাজার । গেট থেকে বেরোনোর আগেই দু’টো পুজো প্যান্ডেল । একটি বঙ্গসমাজের, যার পরিচালনা করে ইনস্টিটিউটের বাঙালি গবেষক, অধ্যাপক ও কর্মীসম্প্রদায় । আরেকটি ক্যাম্পাসের মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত । এই ক্ষেত্রে পরিচালন সমিতি তে অবাঙালি মহিলারাও রয়েছে ।
   বঙ্গসমাজের পুজোর সামনে খানিকটা সময় দাঁড়ান মহিন বাবু । এখানেই তার কিছু পরিচিত মুখ রয়েছে । মায়ের মূর্তির দিকে একমনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একবার প্রণাম করে নেন ।  কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের ভ্রুকুটির মাঝে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে মহাষ্টমীর পুজো চলছে । দূরত্ব, প্রসাদ বিতরণ, অঞ্জলী সবেতেই কড়াকড়ি’র বহর দেখে হাফিয়ে ওঠেন মহিনবাবু । তৎক্ষণাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাজারের দিকে রওনা হন ।
   -“ওহে কি ব্যাপার । অঞ্জলী দেবে না?” পিছন থেকে হিরন্ময়বাবু হাঁক দেন ।
   -“হ্যাঁ ওই একটু বাজার টা নিয়ে এসেই ঢুকছি ভায়া ।”
   -“হ্যাঁ সে তো ঢুকবে তবে এক্কেরে ঘরে । তুমি বাপু এমুখো আজ অবধি হয়েছো কতক্ষণ !” চোখ টিপে মশকরা করে নেন হিরন্ময় বাবু । উপস্থিত বাকি জনাকয়েক অধ্যাপকরা হো হো করে হেসে ওঠে ।
   -“বাজারের ব্যাগ নিয়ে এখানে ঢুকলে চিংড়ি টা যে আজ তোমার পেটেই ঢুকবে ভায়া ।”
   -“চিংড়ি হুম্…তা সে না হয় একদিন খাওয়ালেন ।” পাশ থেকে ভাঙা বাংলায় বলে ওঠেন উদ্ভিদ শারীরবিদ্যার অধ্যাপক কুলভূষণ শ্রীবাস্তব, “বাজার করে একা একা খাবেন, আপনার ক্যান্টিনের ছুটি অত আসানি সে হোবে না কিন্তু ।”
  স্নায়ুবিদ্যার নতুন অধ্যাপক রীতেশ সোনি শ্রীবাস্তবের রুমমেট । তিনি হাঁ করে শ্রীবাস্তবের বাংলা শুনছিলেন ।
  -“ঘাবড়ালে চলবে না বাচ্চা”, অভয় দেন মহিন বাবু, “ধীরে ধীরে সব শিখে যাবে । বেঙ্গলি ইজ় দ্য ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ় হেয়ার, আনঅফিসিয়ালি । তুমি ইংরেজী না জানলেও চলবে । কিন্তু বাংলা ছাড়া…উঁ হুঁ…!”
  -“এই রূপম টা কে বলেছিলাম একবার এখানে থেকেই যাক ।”, উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠেন হিরন্ময় বাবু, “কি অমায়িক ছেলে । উত্তরের ছেলে যেন পাহাড়ের মতো শীতল…,গপ্পে যেন চায়ের মতো আমেজ ।”
  -“ও ভায়া উত্তরের ছেলে তো আমিও । আমায় তো চা-পাহাড়ের সাথে মেলালে না আজ পর্যন্ত !”
   -“তুমি এখন আরব সাগর পাড়ের হাওয়া খেয়ে খেয়ে লবণাক্ত হয়ে গেছ । বেশি খাওয়া চলে না । আবার না হলে মনে হয় কি একটা যেন অভাব । একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ !”
   উপস্থিত বাঙালি অধ্যাপকেরা হিরন্ময় বাবুর কথা শুনে আবারও একবার হাসির রোল তোলে ।
  -“তবে হ্যাঁ কথাটা মন্দ বলো নি । আহা, কতদিন পর ওখানকার কাউকে পেলাম । শুনেছি ওর আসল বাড়ি নাকি ফালাকাটা তে । বাবার সাথেই আলিপুরদুয়ার চলে আসে স্কুল জীবনে । বাবা আলাদা বাড়ি করে সেখানে ”, রূপমের গল্পে মশগুল হয়ে ওঠেন মহিন বাবু ।
  রূপম বসাক মহিন বাবুর ডিপার্টমেন্টের নতুন নিযুক্ত অধ্যাপক । বয়সে অন্ততঃ বছর বারো-তেরো ছোট হবে । যুব প্রাণ, উত্তরবঙ্গ সর্বোপরি খোদ আলিপুরদুয়ারের ছেলে বলে ফালাকাটা-উদ্ভূত মহিন বাবুর বেশ একটা টান জন্মে । আসলে ছেলেটার নামের সাথে তার ছেলেবেলা  ও ফালাকাটা জীবনের অনেক স্মৃতি অতীতে চাপা পড়ে রয়েছে । রূপম নিজেও যতই স্যার বলে সম্বোধন করুক, মহিন বাবুকে সে সম্মান-মান্যতা দিত নিজের অভিভাবকের মতো ।
  বহুবার চেষ্টা করেও তার সাথে মহিন বাবুর দু’দন্ড শান্তিতে গল্প করা, নেমন্তন্ন করা ইত্যাদি সখ্যতা-সাধন হয়ে ওঠে নি । বহুবার জিজ্ঞেস করবেন বলে ভেবেছেন, ওর কোনো ডাকনাম রয়েছে কিনা । কিন্তু অবসর সময়টাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
   -“এবার নাকি ওর জ্যেঠুর বাড়িতে মানে ফালাকাটায় আসবে বলেছে । ওর জ্যাঠাতুতো দাদা নাকি ওর অভিভাবকের মতো । বহু বছর পর যাচ্ছে । আমি তো বলে রেখেছি আমাদের পাড়াটা দেখে আসতে । নেহাত ট্রেন ধরার তাড়া ছিল ওর, তাই আর গল্পে আটকাই নি সেদিন ওকে ।”
   চোখের কোণ ঝলমল করে ওঠে মহিন বাবুর । যেন পরম কোনো আত্মীয়কে নিজের বাড়িতে পাঠাবেন প্রবাসী কোনো বার্তা দিয়ে । নিজের ছোটবেলার পাড়াটা যেন এখুনি হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন তিনি, “শেকড়ের টান হিরু ভায়া । তুমি বুঝবে কি করে ।”
  -“ হ্যাঁ তুমি তো বুঝে বসে আছো !”, মোটা লেন্সের চশমার উপর দিয়ে সকৌতুক দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন হিরন্ময় বাবু, “তা একবার নিজে যাও না কেন ।”
   -“অত কি যাওয়া যায় ভায়া? দেখছো না রোজকার জীবন ।”
  -“রোজকার জীবন নাকি রোজকার সঞ্চয় ! বলি এত টাকা বাঁচিয়ে কি হাতি ঘোড়া কিনবে নাকি !,”
  -“হ্যাঁ হাতি কেনার দায়িত্ব তো এপিজেনেটিক্সের এইচ.ও.ডি-ই নিয়ে রেখেছেন মনে হয় । তাই হাউজিংয়ের দু’টো কিংসাইজ বেডরুম-ও খালি রেখেছেন । আমি তো একটা ঘোড়া-ই কিনব ভাবছি ।”
   প্রবাসের পুজোর প্যান্ডেলের সামনের আড্ডা ম্যাডক্স স্কোয়ারের মতো না হলেও ভালোই জমজমাট তখন ।
   হিরন্ময় বাবু, মহিন বাবুর একপ্রকার সহকর্মীই বলা চলে । এপিজেনেটিক্স ও ক্রোমাটিন বায়োলজি বিভাগের হিরন্ময় বাবুর সাথে কোষবিদ্যা’র মহিন বাবুর সেই প্রথমদিন থেকেই সখ্যতা । তাই প্রায় শুরুর সময় থেকেই দু’জনেরই দু’জনের কথার প্রত্যুত্তরে টিপ্পনি কাটা সাধারণ ব্যাপার । পরিবার বলে কিছু নেই । চিরকুমার হিরন্ময়বাবুর কাছে মহিনবাবুই পরিবার, ভাই ও বন্ধু । বছরে একবার বর্ধমানে নিজের বাড়িতে যান, তখন মহিন বাবু কোথাও ভ্রমণে বেরোন সপরিবারে । সবটাই গ্রীষ্মাবকাশে । আর যদি না গিয়ে থাকেন, তাহলে সে বছর দুই বন্ধু মিলেই বেরিয়ে পড়েন ।
  নিরাপদ দূরত্ব রেখে একটা জটলা জমে যায় বঙ্গসমাজের মন্ডপের সামনে । পুজো বিষয়ে মহিন বাবু যতটাই উদাসীন-অসামাজিক, স্বভাবগতভাবে ততটাই উদ্যম বাঙালি । গল্প জুড়ে দিলে ফোন নাম্বার সংগ্রহ না করে ছাড়েন না । যদিও গপ্পো-গুজব অসমাপ্ত রইলে সেটা ফোনে কখনোই শেষ করা হয়ে ওঠে না তার । কিন্তু ক্যাম্পাসের যে কোনো কারও কাছে মহিন বাবুর ফোন নাম্বারটা হল এমার্জেন্সি নাম্বার ।
   কত কারো কাছে যে নাম্বারটা পড়ে আছে হিসেব নেই ।
   আড্ডায় মগ্ন মহিন বাবুর সম্বিৎ ফেরে মিসড্ কলে । কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অচেনা নাম্বার থেকে পরপর তিনটে মিসড্ কল ।
   হিরন্ময় বাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন ভখন । গপ্পে ব্যাঘাত ঘটায় প্রথম দু’বার কিছু বলেন নি হিরন্ময় বাবু, কিন্তু তৃতীয় বার ফোন বাজার পর বলেই বসলেন, “এগোও বাপু আগে বাজারখানা নিয়ে এস । মনে হচ্ছে তোমার চিংড়ির হাতে সময় নেই আর ।”

তিন

   হিরন্ময় বাবুর রসিকতা সকালে হাসিমুখে উড়িয়ে দিলেও ব্যাপারটা একটু চিন্তায় রেখেছে মহিনবাবু কে । সেই মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যে থেকে শুরু হয়েছে । তিনি লক্ষ্য করলেন, মিসড্ কলগুলো এক নাম্বার থেকেই আসছে ।
   একবার ট্রু-কলার খুলে সেদিনই দেখে নিয়েছিলেন মহিন বাবু । সেখানেও শুধু নাম্বারটাই দেখালো । কোন নাম বা স্থান লোকেশন কিছু নেই ।
   ষষ্ঠীর দিন একবার বাজলো । সপ্তমীর দিন সকাল থেকে পরপর তিনবার করে বাজা শুরু হলো । সকালে বাজলো, তারপরে সন্ধ্যাবেলায় একবার । ফের অষ্টমীর দিন সকাল বেলায় তিনবার । 
  কলব্যাক করেছেন প্রথম দিনেই । কেটে দেওয়া হয়েছিল । অষ্টমীর সকালেও একই ঘটনা । তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছেন, যা হবার হবে,  কলার নিজেই ব্যবস্থা করে নেবে ।
   হিরণ্ময় বাবু নেহাত সেভাবে নেননি বিষয়টা । কিন্তু মহিম বাবু চিন্তা করলেন, ভাগ্যিস পরিবারের কারোর সামনে এমনটা হয়নি । সন্ধ্যেবেলায় সপরিবারে পুজো দেখতে বেরোনোর কথা মহিন বাবুর । গত দু’বছর ধরে পুজোয় প্রবাসী বাঙ্গালীদের ভিড়ভাট্টা, হইচই কোলাহল জমজমাট ব্যাপারটা স্তব্ধ হয়ে গেছে ।
   ক্যাম্পাসের বাইরে এই চত্বরের তৃতীয় পুজো মণ্ডপে এবার বেশ অন্যরকম কাজ হয়েছে । আশির দশকের কিছু পরিচিত বিজ্ঞাপনের কোলাজ দিয়ে পুরো মন্ডপটি সজ্জিত । প্রবেশের মুখে প্রায় ছ-সাত ফুট কাটাউটে ক্যাডবেরি চকোলেটের জেমস বন্ড দাঁড়িয়ে, পাশে ইংরেজিতে লেখা, “ওয়েলকাম, হোয়েন লাইফ ওয়াজ় কালারলেসলি কালারফুল !”
   রতন ও দেবস্মিতা একটু সামনে এগিয়ে গেছে । উর্মি দেবীর পাশাপাশিই মণ্ডপে প্রবেশ করছেন মহিন বাবু । অবাক হয়ে খুঁটিনাটি দেখছিল দেবস্মিতা । রতন ততক্ষনে  গুগল খুলে ‘এইটটি’স পপুলার অ্যাডভারটাইস’ লিখে খুঁজে খুঁজে যতগুলো ছবি পাচ্ছে মিলিয়ে নিচ্ছে মন্ডপের কাটাউট ও চিত্রগুলির সাথে । কোনোটা তৈলচিত্র কোনটা আবার অ্যাক্রিলিক দিয়ে আঁকা হয়েছে ।
   মহিন বাবু ও উর্মি দেবী দুজনেই নস্টালজিক অনুভব করছিলেন । চোখের সামনে ফুটে উঠছিল শোলা’র কজ করা মন্ডপ…বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে এসে সদ্য সমাপ্ত তিরাশি’র বিশ্বকাপের ফুটেজ দেখা…ছোট্ট একটা বাচ্চার নিষ্পাপ মুখ মহিন বাবু স্নেহাতুর চোখে জানলা দিয়ে দেখতেন । নরম তুলতুলে হাত ধরে বন্ধুর সাথে বেরোতেন ঠাকুর দেখতে । 
  আবেগঘন শিহরণে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল মহিন বাবুর । তালটা তখনই কাটলো যখন হঠাৎ করে মহিন বাবুর ফোন বেজে উঠলো একবার ।
   এই মণ্ডপে অন্যান্য জায়গার তুলনায় জনসমাগম একটু বেশি ফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে মহিম বাবু একবার উর্মি দেবীর দিকে তাকালেন । উর্মি দেবী ঠিক সেই মুহূর্তেই কি মনে করে একবার মহিন বাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন, পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে প্রতিমা ও মন্ডপ দর্শন করতে লাগলেন ।
  মহিনবাবু এই কারণে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন মনে হলো উর্মি দেবী কিছু টের পাননি ।
  -“দেখো কার ফোন এল আবার । মিসড্ কল কে করছে আবার এখন ?”
  একটু চমকে উঠলেন মহিন বাবু, “হ্যাঁ মানে ইয়ে…এত ভীড়ের মধ্যে ফোন বের করব…”
  -“ঢঙ্ !”, বিরক্তি প্রকাশ করেন উর্মি দেবী, “কি এমন জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছো !”
  ফোন বের করে চোখ বোলালেন ঠিকই, কিন্তু সেই এক নাম্বার দেখেই তৎক্ষণাৎ পকেটে পুরে নিলেন । এই বিষয়ে সেই মুহূর্তে তাদের আর কোনো কথা এগোল না ।

চার

   নবমী এলেই রতনের খুব মন খারাপ হয় । আসলে ওদের দুই ভাই বোনের-ই সপ্তমী থেকেই মন খারাপ হওয়া শুরু হয় । কিছু বললে বলে পুজোটা তো শেষই হয়ে গেল ।
   সকাল থেকেই বাবার কাছে বায়না জুড়েছে সন্ধ্যের জন্যে ।
   মহীন বাবুও নাছোড়বান্দা, আজ তিনি একটু শুয়ে বসেই কাটাবেন ।
   -“রুতু তো ঠিকই বলেছে কাল থেকে তো আবার সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে ।”, কাতর শোনায় দেবস্মিতা কে ।
   -“আর তোদের এই এক বায়নাক্কা । ঐতো চারখানা পুজো আর কত ঘুরবি বলতো !”, পাত্তাই দিতে চান না মহীন বাবু, “তারচেয়ে বরং আগামীকাল টা কেটে যাক । ভাসান নাচটা নেচে নে ভালো করে ।  তারপর দুদিন সপ্তাহান্তের বিরাম থাকবে । আমরা বরং পরশু লং ড্রাইভে বেরোবো কোথাও একটা নাইট স্টে করে রোববার বিকেলে ফিরে আসবো ।”
  এসব প্রস্তাব আগেও বহুবার পেয়েছে রতন, তাই এখন আর বিশ্বাস হয় না এসব । বিরক্তির সঙ্গে একটা “ধূর !” নিক্ষেপ করে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল রতন ।
 -“এগুলি বাঙ্গালীদের চিরন্তন আবেগ । আমাদেরও কি ছিল না?”, উর্মি দেবী রান্নাঘর থেকেই মহীন বাবুর উদ্দেশ্যে কথাগুলি বলে চলেন, “ফিবছর এমনই দেখে এসেছে । আর কত বছর এরকম ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখবে কে জানে । কেন বাবা, এইতো সামনে একটু হাঁটাচলা করে আসবে এত কিসের আলসেমি ।”
 -“আহা আমি কি ওদেরকে কোথাও নিয়ে যাই না? এইতো ক’টা ছুটি পাই তাও আবার জোর করে নিই ।”, মহিন বাবু প্রতিবাদ করে ওঠেন, “কোন বারই কি তোমাদের নিয়ে কোথাও যাই নি বলতো ?”
  কথাটা কোথাও যাওয়া নিয়ে হচ্ছে না । কথাটা হচ্ছে পুজোয় ঘোরা, পুজোয় আনন্দ করা নিয়ে । বাঙালি হয়েও কি করে বল এসব…!”
  এমন সময় বেজে ওঠে মহিন বাবুর ফোন ।
   -“আজকাল এত মিসড্ কল কে করে তোমায় ? সকালে চা খেতে খেতে মিসড কল… পূজোর প্যান্ডেলে ঘুরতে ঘুরতে মিসকল….! কল ব্যাক করো না কেন বাপু !”
   কোনোমতে আমতা আমতা করে এড়ানোর চেষ্টা করলেও পারেন না তিনি । কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আরও দু’বার বেজে ওঠে ফোন ।
   -“তিনবার করে মিসড্ কল?”, পাশের ঘর থেকে দেবস্মিতা সুর করে চেঁচিয়ে উঠলো, “মা, লক্ষণ তো একটু…”
   -“হ্যাঁ ? মানে?”, উর্মি দেবী কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না,“হ্যাঁ গো…কে ফোন করে গো?”
-“আরে কেউ না কেউ না…বাবার কোনো খাস লোক মনে হচ্ছে…”, এবার রতন কোথা থেকে জুড়ে যায় জবাব দিতে ।
  -“লোক না হয়ে মহিলাও তো হতে পারে”, দেবস্মিতার গলার স্বর টা উস্কানিমূলক শোনায় ।
  -“হ্যাঁ গো । কি বলছে এরা ? এসব কি সত্যি ?”, উর্মি দেবীর ঘোর যেন কাটে না ।
-“হ্যাঁ গো হ্যাঁ । আরে বাবা, বোঝোই না । তিনটে মিসড্ কল মানে তিনটে শব্দ…আই লভ ইউ গোছের কিছু । এবার এখান থেকে বাবা যা উত্তর…”
  রতনের কথা শেষ হয় না । এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সবার সব কথা শুনে চলছিলেন মহিন বাবু । এবারে বাড়াবাড়ি মনে হতে লাগল তাঁর । 
  -“যা নিজের কাজ কর্ গে । যা ! অসভ্য বেয়াদব কোথাকার !”, জোড়ালো ধমক দিলেন রতন কে ।
  দুই ভাই-বোন যেমন থাকার তেমনই রইল । মাঝখান থেকে “ভালোই তো থাকা হচ্ছে !” বলে মুখে আঁচল গুঁজে রান্নাঘর থেকে যেভাবে বেরোলেন উর্মি দেবী, তেমন টা মহিনবাবু শেষ দেখেছিলেন তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পর ।
  তিনি কিছুই প্রতিক্রিয়া করলেন না । শুধু মনে করার চেষ্টা করেন, ড্রয়িং রুমে তিনি কেন এসেছিলেন ।

পাঁচ

   -“ঘুমিয়েছিস রাতে ?”
   হিরন্ময়বাবুর উত্তরে নেতিবাচকভাবে মাথা নাড়েন মহিন বাবু । একান্তই ব্যক্তিগত বা গভীর আলোচনায় দুই সহকর্মী বন্ধুর মধ্যে তুইতোকারি টা চলেই আসে ।
  -“আচ্ছা এমন করলে হয় বল্? নার্ভ, প্রেসার, তোর তো গাদাগুচ্ছের ওষুধ চলে ।”
  -“আরে রাতভর এমন অশান্তি চললে কি আর ঘুম আসে বল্?”, ঘুমের ঘোরে কথা জড়িয়ে এলেও বিরক্ত দেখায় মহিনবাবু কে, “আমি এখনও বুঝতে পারলাম না আমি ঠিক করেছি টা কি ।”
  -“তোর এই সমস্যা টা কদ্দিন ধরে চলছে ? আরে একবার কিছু হিন্ট তো দিবি আমায় ! রোজই তো কথা হয় । কল ব্যাক করেছিস? নাম্বার টা দে তো একবার ।”
  -“কল রিসিভ করছেই না তো । কেটে দিচ্ছে । বাবা এটা কোনো সমস্যা ? স্বাভাবিকভাবে মিসড্ কল আসছে একটা নাম্বার থেকে…”, পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশের ঘর থেকে মহিনবাবুকে থামিয়ে দেন উর্মি দেবী । 
  -“হ্যাঁ সব স্বাভাবিক তো । সওব স্বাভাবিক ।” বলতে বলতেই ডুকরে উঠে ফের ঘরে চলে যান ।
  উর্মি দেবীকে এতটা বিধ্বস্ত আগে দেখেন নি হিরন্ময় বাবু । কিছুক্ষণ থমকে থাকেন তিনি । তার পর সান্ত্বনা দেন, “হ্যারাসমেন্ট কলও তো হতে পারে বৌদি । আপনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন ।” নিচু স্বরে মহিন বাবুকে জিজ্ঞেস করেন, “রুতু আর রুমি কোথায়?”
  -“কোথায় আবার ! অশান্তি লাগিয়ে পগারপার । বেয়াদপের দল যত্তসব ।”
  -“থাম থাম । ওরা-ই বা কি করবে ।” মহিন বাবু কে, শান্ত করার চেষ্টা করেন হিরন্ময় বাবু ।
  -“চা খাবি ?”
  -“চা ? কে করবে তুই ? বাদ দে,” পকেট থেকে ফোর স্কোয়ারের প্যাকেট টা বের করেন হিরন্ময় বাবু, “আমি বরং এটা খাই । তুই বরং আমাকে বল্ তো, নাম্বার টা কি কোনোভাবেও চেনা ঠেকছে ?”
  -“নাহ্ রে । আমি তো ট্রুকলারেও দেখলাম । কিসসু পেলাম না । একটা নাম তো দেখাবে ?”
  -”একটু মনে করার চেষ্টা কর্ তো, গত ক’দিনে নতুন কাকে নাম্বার দিয়েছিস ?”
  -“উঁহু । মনে করতে পারছি না । নতুন কাউকে তো…”
  -“ও হ্যাঁ অবশ্য এমার্জেন্সি নাম্বার কাউকে দিতে হয় নাকি ! বাই ডিফল্ট ফোনে থাকে তো ।”, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন হিরন্ময়  ।
   আজ আর কোনো প্রত্যুত্তর আসে না মহিন বাবুর কাছ থেকে ।
   বন্ধুর অবস্থা টা অনুভূত হয় হিরন্ময়বাবুর ।
   -“চান্দেকর সাহেব কে একবার জানাবো ? আজই আসার কথা পরিবার নিয়ে । দাপুটে ও.সি. কিন্তু ।”
    মহিন বাবু নিচু স্বরে একবার শুধু বলেন, “ভাবছি…” ।
  দেবস্মিতা ও রতন ঘরে প্রবেশ করে । হিরন্ময় বাবুকে দেখে স্মিত হাসে দুজনেই । কি বলবে ভাবতে ভাবতেই রতন বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে শুরু করে । দেবস্মিতা মহিন বাবুর পাশে এসে বসে ।
 -“কালকে ইচ্ছে করে কিছু করি নি বাবা । সো সরি । প্লিজ় খারাপ পেয়ো না ।”
 মহিন বাবু মাথা নাড়েন শুধু । 
 -“শুভ বিজয়া কাকুমণি ।”, হিরন্ময় বাবু কে শুভেচ্ছা জানায় দেবস্মিতা ।
  -“বলেছি না ? আমাদের বিজয়া আসে ভাসানের পর । এনজয় টু দ্য ফুলেস্ট ।”, স্মিত হাসেন হিরন্ময় বাবু,“দর্পণ বিসর্জন দেখলি ?”
  -“হ্যাঁ মহিলা সমিতির টা দেখলাম । বঙ্গ সমাজ টা একটু দেরি আছে বলল তো, তাই চলে এলাম ।”
  -“তোমাদের বঙ্গ সমাজটা এত্ত দেরি করে না কাকুমণি !”
  -“তা তোর এত তাড়া কিসের রে রুমি ? এই তো বছরের চারটা দিন । বাঙালিদের সম্ভব হলে বিসর্জনই দেবে না দুগ্গা মা কে । আমরা আবার কিনা বঙ্গসমাজ !”
   ঘরের পরিবেশ টা অনেকক্ষণ পর হালকা মনে হচ্ছিল মহিন বাবুর । উর্মি দেবী যদিও সেই একইভাবে ভেতরের ঘরে পড়ে রয়েছেন ।
  এমন সময় আবার বেজে ওঠে মহিন বাবুর মোবাইল ফোনের রিংটোন । খানিক চমকে ওঠেন তিনি । হিলারি হান্-এর বাজানো বেহালার সুরটি গতকাল থেকে অপ্রিয় ও বিরক্তিকর লাগতে শুরু করেছে তার ।
  ফের তিনি মনে করার চেষ্টা করতে থাকেন এমন কাকে ফোন নাম্বার দিয়েছেন, কিংবা এমন কে রয়েছে জীবনের পার করে আসা বছরগুলোতে যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় ।
  রতন ও দেবস্মিতা ড্রয়িং রুমেই বসে ছিল । উর্মি দেবী একবার পর্দার পাশে এসে উঁকি দিলেন । 
  পাঁচ-ছয় সেকেন্ড ফোনটা বাজতেই সবার জ্ঞান হল, এবার আর মিসড্ কল নয়, ফোনই এসেছে । 
 হিরন্ময়বাবু দ্রুত ফোন রিসিভ করার তাড়া দিলেন মহিনবাবু কে । মহিন বাবু স্ক্রীনে তাকালেন । সেই এক নাম্বার ।
 -“হ্য…হ্যালো !”, মহিনবাবু যারপরনাই ঘাবড়ে রয়েছেন ।
 -“হ্যালো ! স্যার আমি রূপম ।”
 -“তুমি !”, মহিনবাবুর বিস্ময় ও আকস্মিকতায় চোখে সর্ষেফুল দেখার যোগাড় ।
  কৌতূহলী হিরন্ময় বাবু ও উর্মী দেবীর দিকে ইশারা করে চিন্তামুক্তির বার্তা দিতে থাকেন মহিন বাবু । উর্মি দেবী এবার ড্রয়িং রুমে এসে বসেন । হিরন্ময় বাবু ফিকফিক করে দু’গাল হেসে খবরের কাগজে মুখ গুঁজে নেন ।
 -“আরে রূপম ! কি যে বলি তোমায় ! বলি তুমি তো আমার হার্টফেল করিয়ে দিতে আরেকটু হলেই ।”
  -“এ মা ছিঃ ছিঃ তা কেন স্যার । আসলে রোজকার শুভেচ্ছা প্রতিকী মিসড্ কলেই সারা হয়েছে । আজ তো বিজয়া, বড়দের প্রণাম জানাতেই হয় । তাই ভেবেছিলাম আজ ফোনই করব ।”
  -“তাই বলে মিসড্ কল ? আচ্ছা আমি তো ব্যাক কল করেছিলাম । ধরো নি কেন ? ওহ্ বুঝেছি । রোমিং কাটছে, না?”
 ফোনের ও’পাশ থেকে শীতল বিষন্নতার মতো শান্ত শোনায় এবার রূপম কে ।
 -“আসলে আমি আপনার পাড়ায় রয়েছি । আপনার পাশের বাড়িতেই । এতদিন ফোনগুলো আমার দাদা আপনাকে করত । আপনি চিনবেন হয়তো । বাণীব্রত বসাক ।”
  -“বিলে ?”, উত্তেজক কন্ঠ শুনে ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকে মহিন বাবুর দিকে তাকায় ।
  -“বিলে…কেমন আছে রে সে !”
   মহিনবাবুর আর চিনতে বাকি রইল না । ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি তার ছেলেবেলার রুতু, যার কথা ভেবেই নিজের ছেলের ডাকনাম রেখেছেন তিনি । জন্ম, আলিপুরদুয়ার চলে যাওয়া, পুজোয় দুই দাদার হাত ধরে ঘুরতে বেরোনো…,মিল রোড-চৌপথি-মাদারি রোড হয়ে কিংবা জটেশ্বরের শিবরাত্রির মেলা; ভাবতে ভাবতে গলা জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসছিল মহিন বাবুর । ভাবছিলেন এই যদি একটু পাওয়া যেত বছর পাঁচ-ছয়ের ছোট্ট বাচ্চাটার হাতের আঙুলগুলো, মুঠোবন্দী করে বেরিয়ে পড়তেন পুনে’র রাস্তায় । 
   এতদিন মনে করেও কথা বলে উঠতে পারেন নি তিনি । মানুষের এই স্বভাবটা হয়তো সহজাত । কাছের মানুষদের সাথে যোগাযোগ সাধন, সম্পর্ক স্থাপনে গেঁয়ো যোগী-জ্ঞানে ঢিলেমি মানুষগুলোর সাথে সম্পর্কগুলোকেও সস্তা করে রাখে ।
কিন্তু অপর পাশে তার যে ছায়াসঙ্গী থাকার কথা তার কি খবর সেও তো জানা দরকার ।
   মহিন বাবুর ক্ষণিকের ভাবনা, স্মৃতি বিচরণ-আবেগ বিচ্ছুরণ সবকিছুর যবণিকা পড়ে ফোনের ওপাশে থাকা রুপমের উত্তরে ।
  -“দাদাভাই আপনাকে মিসড্ কল করত । একটু মানসিক ভারসাম্যহীনতা ছিল তো ! বললে বলত আপনিও নাকি এই নাম্বারে ব্যাক কল করবেন, আপনার নাকি কিছু একটা মনে পড়বেই । হয়তো আজও করত । কিন্তু আজ ভোরবেলায় তিনি গত হয়েছেন । সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল । আমি আপনাকে প্রণাম জানাতে পারলাম না, কিছু মনে করবেন না যেন । আসলে অশৌচ পড়েছে কিনা…”,
  মহিন বাবু এরপর আর ফোন ধরে থাকতে পারলেন না । কেটে দিলেন ।
  একটু একটু করে শৈশব-কৈশোর চোখের সামনে ফুটে উঠছিল তার । সেই ল্যান্ডলাইনের যুগে দুই বন্ধুর মধ্যে রোটারি ল্যান্ডফোন ছিল বার্তাবাহক । প্রথম প্রথম দুজনেই কথা বলত যখন তখন, কিন্তু বেশ কয়েকবার চোখরাঙানির পর বাড়ির বড়দের ভয়ে কেউই ফোনে স্বতঃস্ফূর্ত কথাবার্তা বলত না । উপায় ছিল ব্ল্যাঙ্ক কল, যা এই মোবাইলের যুগে মিসড্ কল নামে বিদ্যমান ।
  বহুবার বিভ্রান্তিও ঘটেছে দুই বন্ধুর যোগাযোগে । একবার পুরো এলাকা ঘুরে এসেও বাণীব্রত কে পান নি মহিন বাবু । পরে জানা গিয়েছিল সেটা অন্য কোনো ব্ল্যাঙ্ক কল ছিল ।
  জানাজানি হতেই বিস্তর ধোলাই জুটেছিল দুই বন্ধুর কপালে । বিলে যদিও মন্টু কে কথা দিয়েছিল যতদিন সুযোগ পাবে ব্ল্যাঙ্ক কলই করে যাবে । বিলে’র কথায়, সামনাসামনি আড্ডা ছাড়া নাকি দুই বন্ধুর ঠিক জমে না ।
  ভাসমান সময়প্রবাহে ল্যান্ডফোন বিলীন হয়ে হাতে হাতে মোবাইল এল । মন্টু কবে মহিন হয়ে সাবলম্বী হয়ে চলল, আর মিল রোডের ব্ল্যাঙ্ক কল-শোভিত বন্ধুত্বটা সময়-খনিতে চাপা পড়ল ।
  সেতুর স্তম্ভ বলতে যা-ও বা অস্তিত্ব ছিল দু’জনের, আজ বাণীব্রত’র তরফে সেই এক প্রান্ত-সমেত অতীতের গর্ভে তলিয়ে গেল ।

ছয়

  বিসর্জনের বাজনা বাজতে শুরু করেছে একে একে সব প্যান্ডেলগুলোয় । শরতের ভরদুপুর বসন্তের পড়ন্ত বিকেলের মতো স্তব্ধ । আইআইএসইআর চত্ত্বরে বয়ে চলা মৃদু হাওয়ায় বছর-সমাপ্তির মতো অবসন্ন দীর্ঘশ্বাস, যেন কোন্ জমে থাকা হিসেব দিচ্ছে ।
  রতন ও দেবস্মিতা কে হিরন্ময় বাবু বঙ্গসমাজের পুজোয় নিয়ে গেছেন অনেকক্ষণ । উর্মিদেবী একা ছাড়েন নি মহিন বাবু কে । বন্ধু ও বন্ধুত্ব নিয়ে একটা সময় অনেকগল্প শুনেছেন তিনি মহিন বাবুর কাছে । খবরটা পেয়ে ও সবকিছু পরিস্থিতি মিলিয়ে তিনিও একটু বিষন্ন । বিষন্নতার আরেকটা বড় কারণ উৎসবের দিনে নিজেদের মধ্যে অহেতুক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হওয়া ।
  মোবাইল উঁচিয়ে মহিন বাবু মিসড্ কল করে চলেছেন একটা নাম্বারে । একবার, তিনবার, সাত বার । আজ তার জমে থাকা হিসেব মেলানোর খুব তাড়া ।
  একবার সেই নাম্বার থেকে ফোন এল । ওপারে পরিচিত কন্ঠস্বর ।
  -“স্যার, কিছু বলবেন নাকি ? লাইনটা কেটে যাচ্ছে বার বার ।”
  -“এর পর থেকে স্যার না বলে মন্টু দা ডাকিস আমায় । অভিনয়, ভণিতা, ফরম্যালিটির দরকার নেই একদম,” মন্দ্র কন্ঠে উত্তর দেন মহিন বাবু, “ আর শোন্, আমার সব মনে আছে রে । তোর দাদামনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল না । আমার আসলে স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা তো, দেরি হয়ে যায় মনে পড়তে ।”



কবিতা


অসম্ভব কথামালা...১৯
অথচ

শৈবাল মজুমদার

পাশে নদী ছিলো...ভালবেসে ছুঁইনি কখনো
শিয়রে বৃক্ষশাখে পাখী ছিলো ভোরেরবেলায়
কথা বলিনি তো
এ মাটির পৃথিবীর অবোধ সন্তান তুই মাটি মাখলিনা
ধূলো আর মাটি
রণভূমি ছিলো অবিরল রক্তপাতময়...নদীর ওপারে
নদী পার হতে পারিনি
বিরাট আকাশ ছিলো মাথার ওপরে
ঈগল পাখীর মতো উড়তে চাইনি কোন দগ্ধ দুপুরে
তাই দাঁড়ে বসে ডানা মুড়ে দোল খাই ছোলা খাই
সুখের নাগরদোলায় বসে চোখ বুজে দুলি আর দুলি
পেন্ডুলামের মতো,এই বিপ্লবী এই প্রতিবিপ্লবী
কৈশোর মেঠো আলপথ কখন বদলে গেছে
নিষ্ঠুর কালো রাজপথে
জোনাকীর আলোমাখা অন্ধকার ভেঙে
চারপাশে নকল আলোয় ভাসে নগ্ন সভ্যতা
মাটি নেই ঘাস নেই জল আর শাপলার ফুল নেই বুকে
বেঁচে আছি মরামুখ ছিরকুটে অবিকল মমির মতন
অথচ নদী ছিলো পাখী ছিলো
মাটি ছিলো মায়ের মতন
একদিন ধূলোমাখা ঘামের গন্ধ ভরা প্রেম ছিলো
অনাবিল অসম্ভব কবিতার মতো
লিখতে পারিনি


আয়না

নীলাদ্রি দেব 

আয়তকার কাপড় এঁকে দিলাম, ছাদ 
ওপরে-নিচে গার্হস্থ্য জ্যামিতি 
আকার বদলে দিলে 
 গোলহীন তিনকাঠি পিছু অজস্র গোলকিপার
হাঁসেরা রাস্তা বদল করে, নিয়ন্ত্রিত যানবাহন 
সূর্যের মুখোমুখি বৃত্তাকার আয়না
পিছলে যাচ্ছে যাবতীয় মেঘ




পাথর ও কার্নিভাল

অনিমেষ

শোকের পাথর ভাঙছে আর বড়ো হচ্ছে দীর্ঘজীবী হবার লক্ষণ
মিথ্যে মিথ তুলে দেয়াল রাখছি আশিকীর 

এখন  একটা ধাঁধার উত্তর দিলেই নিশ্চিত   উপহার
একটু আঘাত আর অনেকটা ক্ষত..


মানুষের হালচাল ও পৃথিবী

রেজাউল করিম রোমেল

যখন হেঁটে যাও মানব সভ্যতা
ভালোবাসার সিঁড়িগুলো ফিরে চায়।
থামো, চলো, ফিরে তাকাও-
বিরামহীন ধাপ সমষ্টি ডিঙ্গিয়ে
যাওয়া তোমার ধর্ম।
যুদ্ধ কর-
সময়, বাস্তবতা, সত্যের সাথে অসত্যের।
স্বপ্ন দ্যাখ,
সুখের পেছনে ছুটে যাও,
তুমি তার ঠিকানা জানো না।
ত্রি-চক্র যানে চালক যেমনিভাবে
এগিয়ে যায় শহরের আঁকাবাঁকা পথে।
মাঝি অজানা দিগন্তে খোঁজে
ভাটিয়ালী সুর।
মাঝে মাঝে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বা কাঙ্ক্ষিত
গন্তব্য পাওয়ার উন্মাদনায় পশু হয়ে উঠো,
পায়ের নিচের মাটিকে মনে হয় অচেনা।
নিজ প্রয়োজনে মানুষের ঘাড় মাথা পিষে
আকাশ ধরতে চাওয়া তোমাদের লক্ষ্য।
তাই আজ পৃথিবী তার
লাভ ক্ষতির হিসাব কষতে বসেছে।


ছায়া মানুষ

নাদিরা 

তমাল গাছের ছায়ার দেহে নারীর অবয়ব 
শীতল মাটিতে দেখি স্বদেশ ও পরদেশ 
যার হৃদয়ের গঠনকে ফুলের মতো সুন্দর ভাবতাম,
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে দেখি দানবীয় নগ্ন রূপ। 
নুইয়ে পরা বটের ডালের মতো বেঁচেছিল তরুণী নোয়ারা.... 
একদিন ঝড়ের রাতে ছুটে এসে বলেছিল " দেখো 
আমার বুকে একটা আশশ্যাওড়ার বন "... 
তারপর সারারাতভোর চন্ডীমঙ্গল পড়তো নোয়ারা ;
বইয়ের পাতা থেকে উবে আসতো বেদেনীর নাচ ও গর্ভবতী বেশ্যার গল্প। 
আমার দেশের নাম ভারতবর্ষ বলেই আরাবল্লীর মতো কঠোর হতে পেরেছি 
কয়েকবছর ধরে পায়ের তলা বা পেটে মিথ্যে নিয়ে ঘুরছি। 
আমি আর ভালোবাসতে চাইনা 
সত্যের পর সত্য বলে নগ্ন হতে চাই 
পৃথিবীর সবদিক জুড়ে ধানচাষীদের গান শোনা গেলে
আমরা ভাত খাবার অধিকার পাবো। 
আপাতত ; এই মিথ্যে খিদের নামে আবদার কোরোনা


দুটি কবিতা

সৌরদীপ বর্দ্ধন 


রঙ 

কাল বহুদিন পরে আকাশটাকে বদলে যেতে দেখলাম 
এত দ্রুত মেঘেরা রঙ পাল্টাতে পারে জানা ছিলনা।
নীলরঙা আদুরে ওড়না আর রঙবেরঙের পুতুল নিয়ে বসা ফেরিওয়ালা বাড়ি ফেরার তাড়া দিচ্ছিল। 
আমি আটকালাম, বললাম আমি বাড়ি বানিয়ে দেব কচি ঘাসের উঠোনে। 
তবু সে  দাড়াল না। 
পসার উঠিয়ে নিয়ে গেল, 
ফের কোথাও যদি মেলা বসে। 
আক্ষেপ, খারাপ লাগা নাকি ভয়;
রঙ বদলানোর ভয়!
আমি এতদিন হানাদারদের ভয় পাইনি,
কিন্তু হানাদাররা তৈরী হচ্ছে দূরে পশ্চিমে 
তারাও রঙ বদলানোর অপেক্ষায়!


ভাষা দাও! 

ভাবনারা ডুবে থাকে গভীরতায়,
খানিকটা পেরোলেই যদিও শব্দের কারখানা।
তবু রাস্তায় বিস্তর চড়াই-উতরাই।
ভাষা পেতে গেলে লড়তে হয় অনুভূতিকে।
একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছতে রক্ত ঝরে প্রচুর।
খুব কাছেই বিশ্বাসের পিঠে ছুরি পরে।
বন্ধুত্ব-ভালবাসা,মুখোশ পড়ে চক্কর কাটে,
আর পিছলে পড়া ভাবনাদের গায়ে ছুঁড়ে দেয় জ্বলন্ত মশাল।
দিনদুপুরে ভাষা পেতে গেলে লড়তে হয়! 



লবণ

পলাশ দাস 

ঘাস জমি আর বালির কাছে পড়ে আছে 
আমার আর্থ-সামাজিক অবস্থা 
রোজ শিকড়ের মাটি ঝাড়ার মতো করে ঝেড়ে 
তুলে রাখি সেসব 
তারপর থেকে রোজ - 
আর মনের মধ্যে পুষে পুষে রাখি,
অসম্ভব এক মধ্যাহ্ন দুপুরের রঙ - 
কয়েকটুকরো হলুদ পাতা দেখলে এখনও 
মায়ের কথা মনে পড়ে 
আমি জানি লবণ খুব দরকারি রান্নায় 


                                                       -
অপেক্ষা ও ফুলের অপমৃত্যু

অলোক আচার্য 

একটি শোক সভায় হাজির হয়েছি
এখানে একটি ফুলের অপমৃত্যু ঘটেছে
আজ বিকেলে-
মৃত ফুলটির কাঁটাছেড়া হয়নি বিশেষ অনুরোধে।
একটি ফুলের শোকে,
ধর্মঘট ডেকেছে পৃথিবীর সব ফুল
ওরা ফোটেনি- যেখানে দেবতার পুজার জন্য
একটিও ফুল পাওয়া যায়নি; অথবা প্রেমিকাকে
হাঁটু গেড়ে হাতে তুলে দেওয়ার মতো কোনো ফুল
আজ পাওয়া যাবে না।
ফুলের দোকানগুলো অসীম শূণ্যতায় ভরা
ফুসফুস ভরে উঠছে সৌরভহীন বাতাসে।
আজ কোনো পতঙ্গ ওড়েনি বাগানে অথবা
ফুলের মেলায়। প্রেমিকার সুদীর্ঘ চুম্বন পেতে
আরও একটি দিন অপেক্ষা করতেই হবে।



দুটি কবিতা

তৈমুর খান

রাজনৈতিক 

সভ্যতার আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় 
অন্ধকার মনেদের ভিড় 
আস্ফালন জিঘাংসা জাগে হীন প্রবৃত্তির 
আত্মরক্ষা হবে তবে? 
সংখ্যালঘুর প্রশ্ন বিশ্বাসের কাছে 
বিশ্বাস হারায় রোজ বিবেকহীন দেশে 

তবুও নরম গাল উজ্জ্বল রোদের আভাসে লাল 
শীতকালে ঈষৎ ফেটে গেলে 
চুম্বন ক্রিম লাগায় রোজ, যত্নআত্তি করে


ব্যতিক্রম

ব্যতিক্রমকে আমি চিনি 
আমাদের পাড়ায় থাকে
হ্যান্ডসাম দেখতে, টল্ ফিগার 
সব শব্দেরা ওর প্রেমে পড়ে যায় 
সব ক্রিয়া বিশেষণ কাঁপে 
সব কথা ফুলের বাগানে ফুল হয় 
আমি তৎসমের কাছে বসি 
দেশী ও বিদেশী ফণাগুলি দোল খায় 
ব্যতিক্রমকে তাদের মাথায় বসাই 
যদিও কলহে বন্ধ কথা কথাবাহিনীর
 উৎসব ফিরবে আবার, মুখোশ খুলে খুলে দেখি



পুরোনো কথার ইতিহাস

বেনাজির হাবিবা

ব্যস!আর কটা দিন, তারপর মনে থাকবে না রসসিক্ত দিনগুলো.. 
মনে নাড়া দেওয়া অতীত,  
হাঁটতে হবে সেই তিক্ত পথে, 
চেনা রাস্তায় জমবে কুয়াশার 
মিছিল, 
মনে কত দ্বন্দ্ব হবে, নরম শিলায় আঘাত পড়ে বদলে যাবে রূপ, জীবনের সুর, 
কালের আগমনে হারিয়ে যাবে  
স্মৃতির ইতিহাস।। 

      
সন্ধান

অমিত দত্ত

বোধিসত্ত্ব,  ঘুমিয়ে আছ নাকি?
 এই ছায়া নগরে অস্ফুট ফিসফিস শোনা যায়, 
 তারা ফাঁদ পাতে, 
 বেগড়বাই শব্দ ধরবে বলে, 
  বোধিসত্ত্ব ঘুমিয়ো না
 ওদের দেওয়া পায়েসও খেয়ো না, 
 ছাঁচের বাইরের মূর্তিকে ওরা ভেঙে ফেলে ।
 আরশিনগরে নেই আজ কোনও ভাঙা কাচও 
পাছে তুমি আমি নিজেকে দেখে ফেলি, 
বোধিসত্ত্ব জেগে থাক, 
তুমি আমি আজ রাতে নিষিদ্ধ অভিসারে
ধিকি ধিকি রুটি সেঁকা আগুনের খোঁজে




ছড়া

ভুজুং

মাথুর দাস

বটতলে এক জ্যোতিষ বসে রতীশচন্দ্র সাহা
বাবার ছিল মুদি দোকান ফেল মারতো ডাহা
ভুজু্ং ভাজুং নিয়ে শিখে
নাম ছড়ালো দিকে দিকে
এখন সে জ্যোতিষার্ণব, বিরাট পসার আহা !


ভয় নয় হবে জয়

কিশোর কুমার দলুই

সময়টা যে বড্ডো কঠিন নাক-মুখ সব ঢাকো ।
নিয়ম বিধি না মানলে রেহাই পাবে নাকো ।
অনেক গল্প অনেক গুজব 
আসছে ভেসে কানে।
যে যা খুশি বলেই ফেলে 
সবাই কি সব জানে ?
ভয় পেয়োনা জয় হবে ঠিক রাখবে মনে বল ।
কাজ নিয়ে সদা ব্যাস্ত থাকো লক্ষ্যে অবিচল ।
আর শোনো বলি চলবে এখন
 সঠিক নিয়ম জেনে ।
 ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মীর 
পরামর্শ মেনে ।



                   
গল্প

র‌্যাগিং

অপরাজিতা পাল




আজ তিন মাস হতে চলল দোকানের কাজটা চলে গেছে। শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসার পর বাপের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি সুদীপ্তার। দোকানের কাজটা সাথে সাথেই পেয়েছিল তাই লেডিস মেসে এসে উঠেছিল। মেসের খরচ মেটানোর পর খুব বেশি টাকা থাকতো না হাতে। তাও চালিয়ে নিচ্ছিল কোনরকমে। কিন্তু দোকানটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজটা চলে যায়। এই তিনমাস মিহিরদার কাছে ধার নিয়ে চালাচ্ছে। তবে তা কতদিন ?.মানুষটা ভালো বলে চলে যাচ্ছে । সেই ছোটবেলা থেকেই সুদীপ্তাকে দেখেছে তো, তাই বোধহয় মায়া হয়। 
দুপুরের খাবার খেতে খেতে সুদীপ্তা এসব ভাবছিল। মেস টা এই সময় একদম নিরিবিলি থাকে। মেসের মালকিন আর কাজের দুই দিদিদের যেটুকু কলকলানি শোনা যাচ্ছে। মেসের  কেউ কলেজে গেছে , কেউবা চাকরিতে। সুদীপ্তার মত দশা তো ওদের নয়। সুদীপ্তার লজ্জা করে ওদের সামনে আসতে । ওরা যখন বেরোয় যে যার কাজে, মাথা নিচু করে জল খাবার খায়। কেউ কেউ তো আড়চোখে মুখ টিপে হাসে, চোখ এড়ায় না সুদীপ্তার। এক একটা দিন যেন এক এক যুগ। অসহায় লাগে নিজেকে।
 এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে, এমন সময় দেবারতি,  মেসের ই মেয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছুটতে ছুটতে ঢুকে হাঁপাতে থাকে। 
মেস মালকিন কাকিমা এসে বলে যে," হাফাচ্ছিস কেন কি হয়েছে?" 
দেবারতি বলে," সুলেখা ও মহুয়া মিলে কবিতাকে কলেজের মধ্যে চড় মেরেছে।"
 কাকিমা ও সুদীপ্তা দুজনেই আঁতকে উঠে বলে," সে কি? "
দেবারতি  আবার বলে," হ্যাঁ কাকিমা,  কবিতা প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ জানিয়েছে । জানিনা কি হবে!" 
কাকিমা বলে," সুলেখা ও মহুয়া এখন কোথায়? ওরা ফিরছে না কেন ?"
দেবারতি বলে," আমি বললাম মেসে চল। শুনলো না আমার কথা । ওখানে ঝামেলা করছে এখনো।" 
সুলেখা ও মহুয়া ও এই মেসে থাকে । দেবারতির সাথেই পড়ে । কবিতা প্রথম বর্ষের ছাত্রী ও মেসে থাকে না বাড়ি থেকে যাতায়াত করে।
 কদিন যাবৎ মেসের সকলেই এই নামটার সঙ্গে পরিচিত । যদিও কবিতাকে মেসের কেউ সামনাসামনি দেখেনি। আসলে স্মার্ট, সুন্দরী। কলেজের ছেলেরা তার দিকে আকৃষ্ট । এটা অনেকের কাছেই ঈর্ষার  বিষয় হয়েছিল। সুলেখা ও মহুয়ার বয়ফ্রেন্ডও ঐ আকৃষ্ট ছেলেদের দলে ছিল । তাই সুলেখা, মহুয়ার এত রাগ কবিতার উপর । কিন্তু তা বলে চড় মারবে? 
এমন কি হলো! সুদীপ্তা ও মেসের কাকিমা বুঝে ওঠার আগেই সুলেখা ও মহুয়া সদর্পে গটমট করতে করতে ঢুকলো। ওরা সকলেই সুদীপ্তার থেকে অনেক ছোট। তাই সুদীপ্তা বড় দিদির মতই সুলেখা দের  বলল , "এটা কি করলে? এবার কোথাকার জল কোথায় গড়ায় দেখো!"
 উত্তরে সুলেখা উচ্চস্বরে সুদীপ্তা কে বলে ওঠে," বাড়িতে বসে বসে অনেক কথাই বলা যায় সুদীপ্তা দি। স্পট ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতা থাকা চাই । তুমি ওসব বুঝবে না বাড়িতে থাক তো।" 

সুদীপ্তা সপাটে আঘাতটা খেয়ে কথা বলতে পারছিল না। 
মেসের কাকিমা একটু ধমক দিয়ে বলে ওঠে ,"সুদীপ্তা তো ঠিকই বলেছে। কি ঘটলো যে মারতে গেলি?"
 মহুয়া বলে," খুব বেড়েছিল কাকিমা। আর নেওয়া যাচ্ছিল না । শেষে কিনা সুলেখার বয়ফ্রেন্ড সুরেন এর গালে কিস করল! এত সাহস ! "
কাকিমা বলে, "এ্যঁ,  সুরেন কি বাচ্চা ছেলে নাকি, ও কিছু বলেনি ?"
  দেবারতি বলে," ছেলে গুলোই তো চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল ।সুরেন কলেজের জি.এস. পারবি ওকে কিস করতে ?প্রথমে রাজি হয়নি, পরে ভয় পেয়ে কাজটা করে। "
 সুলেখা বলে," চ্যালেঞ্জ দিলেই ও তাই করবে? চরিত্রহীন মেয়ে একটা।"
 দেবারতি বলে," কেন? ও তো বললো বোন দাদাকে কিস করতেই পারে।"
 মহুয়া বলে , "ন্যাকা। দাদা? হুঃ সুলেখা ঠিক করেছে। আমিও অবশ্য ছাড়িনি, পরে দিয়েছি দু ঘা। জ্বালা জুড়োলো। চল চল সুলেখা ঘরে যাই।"
 বলে ওরা দোতলার দিকে পা বাড়ায় । 
কাকিমা বলে ,"জ্বালা জুড়োলো না বাড়লো তা কে জানে!"
 সুদীপ্তা মনে মনে বলে," সময়ই সে উত্তর দেবে।"

 তাই হল ক্রমশ সময় উত্তর দিতে লাগল। বিষয়টা anti-ragging কমিটির কাছে পৌঁছলো। পুলিশ এল ,মিডিয়া এলো । শান্ত শহর যেন হাতে গরম খবর পেয়ে আলস্য ঝেড়ে, রোজ কলেজের সামনে এসে খোঁজ নেয়, সেদিনের আপডেট কি। 
 যা দাঁড়ালো তা, সুলেখা- মহুয়া -সুরেন সহ 5 জনের নামে কেস উঠলো কোর্টে। 5 জনকে এক বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হলো।
 কবিতাকে অন্য কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। কেস অবশ্য চলতে থাকলো।
 এ তো গেল আইনের হাত।
 এবার দিন গড়িয়েছে দুপুরবেলা সুলেখা এখন সুদীপ্তার সাথে খেতে বসে । ও সাসপেন্ড হয়েছে বলে ওর বাবা বাড়ি ঢুকতে দেয়নি। মা চাকরি করেন তাই মেসের খরচ পাঠিয়ে দেন।
 মহুয়াকে ওর বাবা পড়া ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। সেও এখন বাড়িতে।
 অর্থাৎ সুদীপ্তা- সুলেখা- মহুয়া তিনজনেই এখন কর্মহীন "বাড়িতে বসা মানুষ"। মাস 4/5 হয়ে গেছে। সুদীপ্তা  সেলাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। পাশাপাশি ওপেন ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। 
দেবারতির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষার পরেই বিয়ে । 
মহুয়া নাকি ওর বাড়ির কাছে একটি স্কুলে পড়াচ্ছে। আর সেই স্কুলের প্রধানের সাথে বিয়ের কথা চলছে।
 শুধু সুলেখা এখন মেস বাড়িতে দুপুরবেলা একা বসে খায় । একা জানালায় বসে থাকে। একদিন হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার "স্পট ডিসিশন" ও নিয়েছিল । 
কেটে গেছে চার বছর সুদীপ্তা এখন মেসে থাকে না। নিজের সেলাইয়ের ব্যবসা খুলেছে। মেসে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে, ঘর ভাড়া নিয়েছে। দেবারতি এক বছরের শিশু সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করছে।
 স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে বিয়ে পর দু মাসের মাথায়  আত্মহত্যা করে মারা যান মহুয়া র বর।  তখন মহুয়া গর্ভবতী। তখনও রাগিং এর কেসটা শেষ হয়নি। চলছে । মাঝেমধ্যেই ওদের হাজিরা দিতে হয় কোর্টে।
 কি ভাবছেন সুলেখার কথা বলছি না কেন? সুলেখা আজ এক বছর হল মারা গেছে।
 হ্যাঁ , ঠিকই শুনছেন সুলেখা মারা গেছে । সুরেন এর সাথে বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে নিত্যদিন রাগিং করা হতো ওকে। ভাঙ্গা শরীর ও মনে বাচ্চার জন্ম দিয়ে পৃথিবীর আদালত থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।

দৃষ্টি

সুব্রত দত্ত



       
শুভ বাবা মায়ের সাথে আর দীপ্তসি মায়ের সাথে ট্রেনের একই ক্যুপে জার্নি করে কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদে এসেছে। শুভ-র বাবাকে gastroenterology হসপিটালে আর দীপ্তসি চোখের চিকিৎসা করাতে এসেছে। ট্রেনেই দুই পরিবারের মধ্যে বেশ সখ্যতা গভীর হয়। শুভ আর দীপ্তসি একে অপরের পেছনেও লেগেছে। দীপ্তসিদের সুবিধের জন্য আই হসপিটালের কাছেই একটা লজে পাশাপাশি দু'টো ঘর ভাড়া নিয়েছে। শুভ-র বাবার কোলন ক্যানসার ধরা পড়েছে। এক সপ্তাহ পরে অপারেশন হবে। আর দীপ্তসির পছন্দের চোখের ডাক্তার তিনদিন পর দেখবেন। শুধু শুধু ঘরে বসে থেকে বোর না হয়ে শহরটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। ওরা, মনে শুভ আর দীপ্তসি। আজ তাই চা খেয়ে সাতটায় বেরিয়ে যায়। এত কাছে জুবিলী হিলস-এ এত সুন্দর একটা দেখবার মতো জায়গা আছে, তা ভাবতে পারে নি দীপ্তসি। প্রায় চার শ'-একর জায়গা নিয়ে তৈরি KBR National Park. কংক্রিটের জংগলের মাঝে যেন স্বাস নেওয়ার জন্য প্রাকৃতিক একটা ফুসফুস। এটা ভোর থেকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত খোলা। তারপর আবার বিকেলে খুলবে। টিকিট কেটে ওরা ভেতরে ঢোকে। আঃ, এ যেন উদ্ভিদ আর প্রাণীজগতের প্রাকৃতিক মেলবন্ধন! অত্যাধুনিক শহরের মাঝে হঠাৎ পাওয়া স্নিগ্ধ সবুজ বনানী। মরুভূমিতে মরুদ্যান খুঁজে পাওয়ার মতো বিষয় যেন! ওরা হাঁটতে হাঁটতে দেখে যাচ্ছে। প্রায় ছ'শ প্রজাতির গাছগাছালি,১৪০ রকমের রঙ বেরঙের পাখি এখানে সুরক্ষিত। এদের মধ্যে প্যাঙ্গলিন, ময়ূরও রয়েছে। ২০ প্রজাতির সরীসৃপও রয়েছে। দীপ্তসি সব চেয়ে খুশি নানা রঙের নানান আকারের প্রজাপতি দেখে। এক জায়গায় এতগুলো প্রজাপতি দেখতে পাওয়া মোটেই সহজ কথা নয়। দীপ্তসির খুব ইচ্ছে করছে ওই প্রজাপতিগুলোকে ধরে আদর করে দেয়। কিন্তু উপায় নেই। ওগুলোকে ধরা বারন। অনেকটা পথ হেঁটেছে। প্রজাপতিদের ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না। শুভ-র তাড়া খেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। পার্কের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য স্থান হলো চিরাণ প্যালেস। এটা ছিল রাজকন্যার বাসস্থান। সেখানে রয়েছে গোল বাংলো, মোর বাংলো, গোশালা, ঘোড়াশাল আর হাতিশাল। সুন্দর বাতাস বইছে। তাই ওরা প্যালেসে বসেই কাটায় বেশ কিছুটা সময়। দশটা বাজতেই বেড়িয়ে লজে ফিরে আসে। দীপ্তসির চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে শুভ খুশি হয়।
    স্নান সেরে শুভ খাবারের অর্ডার দিয়ে তার মা  সুনন্দাকে বলে,
---মা, তোমাদের তিন জনের জন্য খাবার আসবে। আমরা বাইরেই খাবো।
---ঠিক আছে, যা বাবা। ঘুরে আয়। কাল থেকে তো আবার ছুটোছুটি করতে হবে।
    শুভ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু বলে,
---হুঁ! তুমি বেশি চিন্তা করো না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। হাঁক দিয়ে বলে,
---দীপ্তসি, আপনার হলো?
    দীপ্তসি তাদের ঘরের ভেতর থেকে বলে,
---এই তো, আসছি।
    দীপ্তসি বেরিয়ে আসে। বলে,
---চলুন, আমি রেডি!
    দীপ্তসির মা কণিকা পেছন পেছন এসে বলে,
---তোরা যাবি কোথায়? 
    শুভ বলে,
---নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করতেই এক জায়গায় যাচ্ছি। আমিও ঠিক জানি না। তাই এসেই বলবো।
---জানি না বাপু। তোমরা যে কি করো। কাল যেসব জাগায় গিয়েছিলে, সবই শুনলাম। সেসব সম্বন্ধে তো আমাদের কোনো ধারনাই নেই।
---তাহলে আজ চলুন।
---না বাবা, দরকার নেই। তোমরাই যাও।
    সুনন্দা বলে,
---হ্যাঁ, ওসব আমরা বুঝবো না। 
    শুভ বলে,
---আমরা তাহলে আসি। আন্টি, আপনারা সময়মতো খেয়ে নেবেন।
    শুভ আর দীপ্তসি বেরিয়ে যায়। অটো ড্রাইভারকে বলে,
---হাইটেক সিটি, ইনঅর্বিট মল চলো।
---বৈঠিয়ে।
    দীপ্তসি অবাক হয়ে বলে,
---মলে কেন যাচ্ছি। কিছু তো কিনবো না। 
---লাঞ্চ করতে যাচ্ছি Dialogue in the
   Dark"-এ। কেন, আপত্তি আছে?
---খেতে যাবো অতোদূরে?
---হ্যাঁ, তাই যাবো। (ভেংচি কেটে) তারপর ওখান 
   থেকে বেরিয়ে বলবে ...
 দীপ্তসি তাকায়। শুভ আমতা আমতা করে বলে,
---না, মানে বলবেন। হ্যাঁ, বেরিয়ে বলবেন -
    ইউরেকা!
---তা ঠিক নয়। আপনি কাল যেসব জায়গায়
    নিয়ে গিয়েছেন, খারাপ লাগে নি। 
    মলের সামনে অটো দাঁড়ায়। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ফিফথ ফ্লোরে এক রেস্তোঁরার সামনে এসে শুভ বলে,
---এই সেই জায়গা।
    দীপ্তসি নামটা দেখে। "Dialogue in the Dark" দেখে ভ্রু কুঁচকে যায়। শুভ ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে। মহিলা রিসেপশনিস্ট হাসিমুখে আহ্বান করে,
---Welcome Sir and Ma'am. You are in such a restaurant, in which you get to experience food and taste in complete ...
    শুভ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
---Please, let us experience the very unexpected phenomenon.
---Ok Sir. This is our menu card. We serve starters, proper main menu and then dessert. Please, place your order.
    শুভ দীপ্তসিকে জিজ্ঞেস করে,
---আপনি কি খাবেন, ভেজ নাকি নন-ভেজ?
---আপনি?
---মঙ্গলবার আমরা ভেজ খাই।
---তাহলে আমিও তাই খাবো।
---হুঁ, ঠিক আছে।
    শুভ দু'জনের খাবারের অর্ডার দেয়। রিসেপশনিস্ট বলে,
---Sir, you have to keep all your belongings like phones, watches, glasses etc. in the locker and then you may enter into the room.
    দীপ্তসি অবাক হয়ে শুভ-র দিকে তাকায়। শুভ বলে,
---Excuse me. May I know the reason?
---Why not Sir? We don't allow to take such things which may cause reflection in the room.
---Ok. Thank you.
---Most welcome, Sir.
    ওরা তাদের সব জিনিস লকারে রাখে। এবার রিসেপশনিস্ট গেট খুলে দিয়ে বলে,
---please keep inside. Some one is waiting to guide you.
    ওরা ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার! দীপ্তসি ভয় পেয়ে বলে,
---এ কোথায় এলাম? আপনি কোথায়?
---এই তো, এখানেই আছি।
দীপ্তসির গলায় আতঙ্কের স্বর,
---কিছুই বুঝতে পারছি না তো!
---একটু ধৈর্য ধরুন। unexpected experience-এর জন্যই তো এখানে এসেছি।
---ধুস, আমার ভয় ভয় করছে।
---ধ্যাৎ, ভয়ের কি আছে। আলোতে রোজই খান। আজ না হয় অন্ধকারেই খাবেন! অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
    ঝকঝকে ইংলিশে এক পুরুষ কন্ঠ বলে ওঠে,
---Good afternoon Ma'am. Welcome to our wonder world. I'm Shankara. Please, hold your hands each other. 
    কন্ঠস্বর শুনে একটা মানুষের চেহারা সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে হলো। মনে হলো বেশ স্মার্ট এক যুবক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।। শুভ তার হাত ধরছে না দেখে দীপ্তসি বলে,
---কি হলো, হাতটা ধরুন!
---কেন, আপনি ধরতে পারছেন না?
---না, আপনিই ধরবেন।
---তাহলে "আমার হাত দু'টি ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা" গানটা গেয়ে ফেলুন দেখি!
---সব সময় পেছনে লাগতে ভালো লাগে, তাই না?
    দীপ্তসি সেই কণ্ঠস্বরের উদ্দেশ্যে বলে,
---Hello! 
---Yes ma'am.
---It is too dark. Why don't you switch on the lights?
---Sorry ma'am. There is no light here.
---Oh! Then Ok.
---Ma'am, Please hold your hands and follow my footstep noise.
    খট খট করে জুতোর শব্দ এগিয়ে যায়। শুভ বাধ্য ছেলের মতো দীপ্তসির ডান হাত ধরে শব্দ অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
---ভয় নেই, আমি আছি তো!
---হ্যাঁ! কি আমার বীরপুরুষ রে। বিপদগ্রস্ত একটা মেয়ের হাত ধরতেও ভয় পান, আবার বড় বড় কথা বলছেন?
---ওঃ, এখানেও ঝগড়া করবেন?
    গাইড বলে,
---Ma'am, we are going to take a right turn.
---Alright.
---We're almost there ma'am. A-n-d now we are here. Can you feel the chair in front of you? 
---Ummm, yes, yes, I can. (শুভকে বলে) আপনি পেয়েছেন তো?
---হুঁ।
---please be sitted.
---Hmmm.
---I'll be right back. 
    ওরকম অন্ধকারকে সয়ে নিয়ে বসতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। একটু পরেই ফিরে এলো সেই কন্ঠস্বর,
---Ma'am, there are plates on the table on which we'll serve your food.
    ওরা হাত দিয়ে অনুভব করে প্লেটগুলোকে।
---Yes, I've got it.
    তারপর সে নিয়ে এলো ফিঙ্গার বোল, হাত ধোয়ার জন্য। সেটা টেবিলের একদিকে রাখলো, তাও শব্দ শুনে আন্দাজ করে নিতে হলো। সে বলে,
---Please, wash your hands.
 ওরা হাত ধুয়ে নেয়। দীপ্তসি বলে,
---আচ্ছা, আমরা তো কিছুই দেখতে পারছি না অন্ধকারে। তাহলে ওরা কি করে সব কাজ এত সহজে করতে পারছে? ওদের কোনরকম অসুবিধে হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না!
---এটাই তো এখানকার বিশেষত্ব! 
    তারপর তাদের খাবার এলো একে একে। প্রথমে স্টার্টার, তারপর প্রপার মেইন কোর্স এবং শেষে ডেজার্ট। সবকটা খাবারই ভীষণ সুস্বাদু। যদিও সেগুলো দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, গন্ধটা পাচ্ছে ওরা। মুখে স্বাদ পাচ্ছে। কিন্তু খাবারটা দেখতে না পেয়ে একটা কিছুর অভাব অনুভূত হচ্ছে। গাইড বলে,
---Ma'am, please you feel the texture, smell and taste of the food and imagine it.
    সত্যিই তাই । খাবারটাতে হাত দিয়ে বুঝে নিতে হচ্ছে, সেটা দেখতে কেমন হতে পারে। সাধারণ ভাবে কিছু খেতে গেলে প্রতিটা ইন্দ্রিয় দিয়ে তার চেহারা, স্বাদ, গন্ধ, চামচ- প্লেটের শব্দ বা টেক্সচার পরিপূর্ণ ভাবে অনুভূত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সব কটা ইন্দ্রিয় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। খাবারটা দেখতে না পারায় একটা অসম্পূর্ণতা অনুভব করছে তারা। অথচ সব ইন্দ্রিয়কে যখন কাজে লাগানো হয়, তখন প্রত্যেকটাকে আলাদা আলাদা ভাবে অনুভব করা  যায় না। প্লেট থেকে মুখের দূরত্বের কথা কেউ ভাবে? এটা একদম আলাদা এক অভিজ্ঞতা। সেই বিষয়টা এরা এই অন্ধকারে কিভাবে ম্যানেজ করছে তা শুভ-রা ভেবে পায় না। তাহলে কি তারা কোনো প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এসব করে? খাবার সার্ভ করা, প্লেট চেঞ্জ করা, যাওয়া আসা - এসব তাহলে সম্ভব হয় কি করে! দীপ্তসি তো কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে গিয়ে তার মুখ কোথায় বুঝতে না পেরে নাকে খোঁচা খেয়ে "উঃ" শব্দ করে ফেলে। উৎকন্ঠিত হয়ে শুভ জিজ্ঞেস করে,
---কি হলো?
---কিছু না।
---তাহলে "উঃ" করলেন কেন?
---সব বলতে হবে? তারপর তো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন।
---ধ্যাৎ, বলবেন, নাকি আপনাকে ফেলে বেরিয়ে যাবো?
---এই নাঃ। চলে যাবেন না প্লিজ। আমি বলছি।
---হুঁ, বলুন।
---কাঁটা চামচের খোঁচা খেয়েছি নাকে?
    শুভ খুব কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলে,
---যাক, আপনার সম্পর্কে নতুন তথ্য জানলাম।
---কি তথ্য?
---আপনি নাক দিয়ে খান।
---উঃ, আপনাকে বলেই ভুল করেছি।
---না না, ঠিক আছে।
    যাই হোক, কষ্টে সৃষ্টে অথচ অনন্য এক আবহে খাওয়া শেষ করে ওরা। শুভ দীপ্তসিকে জিজ্ঞেস করে,
---আপনার খাওয়া হলো?
---হুঁ, ও বাবাঃ, এই শেষ করলাম।
    শুভ গাইডকে বলে,
---Hello! We've completed our task.
    গাইড হেসে বলে,
---Did you like it Sir?
---Oh yes. It is an unparalleled amazing  experience.
---The world call them "blind", who can't see. But we name it "visually challenged." The God gives them a challenge of not having eye-sight. And they accept the challenge. They want to share to all that how they live their normal lives. That is the initiative of "Dialogue in the Dark."
---Yes, we are visually challenged or impaired in the world of darkness. But you are expert here. Thank you for giving us this amazing experience. Now let's go out.
---Ok Sir.
    সেই শব্দ অনুসরণ করে শুভ-র হাত ধরে দীপ্তসি বেরিয়ে আসে। দরজা খুলতেই আলোর ঝলকে তাদের চোখ কুঁচকে যায়। চোখ স্বাভাবিক হতেই ওরা গাইডের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে ভাবলেশহীন এক গাল হাসি আর পাথরের চোখ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দীপ্তসি চমকে ওঠে। গাইড ভেতরে চলে যায়। কিন্তু দীপ্তসির ভেতরটা এমন ভাবে মুচড়ে ওঠে যে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। শুভ-র বুকের ওপর মুখ লুকিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলে। শুভ আচমকা দীপ্তসির পরিবর্তিত মানসিক অবস্থানে বিহ্বল হয়ে মাথায় তার দু'হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
---এরকম করছো কেন? চুপ করো। শান্ত হও। আমি আছি তো পাশে। আমার দিকে তাকাও। তাকাও!
    দীপ্তসি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই শুভ-র দিকে তাকিয়ে বলে,
---আমি যে আমার ভবিষ্যৎ দেখতে পেলাম।
---কে বলেছে? দেখবে তোমার চোখ ঠিক হয়ে যাবে। আর আমার ওপর বিশ্বাস আছে তো। আমি তোমার  পাশে আছি। হ্যাঁ, সারা জীবন।
---আপনি তো এখানে চাকরি করবেন। আর আমি থাকবো কলকাতায়।
---ধ্যাৎ পাগলী। কে একজন বললো, আর তাতেই আমি নাচবো, তাই হয় নাকি? (দীপ্তসির নাকটা টেনে ) আমিও কলকাতায় থাকবো।
---সত্যি!
---হ্যাঁ, তিন সত্যি।
    শুভ দীপ্তসিকে শান্ত করিয়ে বলে,
---একটু দাঁড়াও। আমি বিলটা মিটিয়ে দিই।
   দীপ্তসি শুভ-র হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলে,
---না, আজকের বিলটা আমি পে করবো।
---কেন? আমিই এনেছি তোমাকে।
---না আমি। কারণ, আজ আমি জীবনের শুভকে উপহার পেয়েছি।
---তাই? ঠিক আছে, তুমি আমাকে সব দিক দিয়েই বেঁধে দিয়েছো।
    দীপ্তসি বিল মিটিয়ে দেয়। রিসেপশনিস্ট শুভকে জিজ্ঞেস করে,
---What happened? Anything wrong?
---No no, nothing happened. She was cut to the quick by their troublesome lives.
    শুভ লকার থেকে তাদের জিনিসপত্র বের করে নিয়ে নতুন সম্পর্কে উদ্দীপ্ত হয়ে দীপ্তসির হাত ধরে বেরিয়ে যায়।




অণুগল্প

কৌশল

সোমনাথ বেনিয়া


একটি সভাঘরে কবিসম্মেলন চলছে। অনেকের সঙ্গে আমিও বসে আছি। এক-এক করে কবিরা মঞ্চে উঠছে আর কবিতা পড়ে নেমে আসছে। আমার পালাও একসময় শেষ হলো। বসে আছি বাকিদের কবিতা শুনবো বলে। এমন সময় এক তরুণ কবি কবিতা পাঠের জন্য মঞ্চে উঠলো। পকেট থেকে কবিতা লেখা কাগজটি বার করে চোখ থেকে চশমা খুলে কবিতা পাঠ শুরু করলো এবং যথারীতি পাঠ শেষে নেমে এসে নিজের জায়গায় বসলো। সভা শেষে সেই কবির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, "লোকে চশমা পরে লেখাকে পরিষ্কার দেখার জন্য। কিন্তু তুমি কবিতা পাঠের সময় চশমা খুলে পকেটে রাখলে কেন? আসলে তোমার চশমার লেন্সটা খেয়াল করেছিলাম বেশ মোটা মানে পাওয়ার যথেষ্ট বেশি। তাহলে?"
     উত্তরে স্মিত হেসে সেই তরুণ কবি বলে, "আসলে জনগণের সামনে মঞ্চে কবিতা পাঠ করতে উঠলে ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপে। এটাকে গ্লোসোফোবিয়া বলে। তাই এইরকম ধরণের সব পরিস্থিতিতে আমি চশমা খুলে রাখি এবং বলতে গেলে আমার সামনে কে আছে বা কে নেই তা দেখতে পাই না বললে চলে, মানে সাময়িক অন্ধ হ‌ওয়ার চেষ্টা করি। সব আবছা। ফলে ধরে নিই আশেপাশে কেউই নেই। আমি একা। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই এবং যথারীতি কবিতা পাঠ করতে বা কিছু বলতে পারি ..."



শিল্পী : অন্তরা সূত্রধর 






Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন