সাক্ষাৎকার: ꣲশ্যামাদাস বক্সী — বক্সী পরিবার ও সমকালীন কুচবিহার | ঋষিকল্প পাল

 




অবতরণিকা: বর্তমান শতাব্দীতে এখন পর্যন্ত যে উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনাগুলি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার মধ্যে বিভীষিকাময় করোনা মহামারী নিঃসন্দেহে অন্যতম। নীচের সাক্ষাৎকারটি যখন গ্রহণ করা শুরু হয়েছিল তখনও মানব-সভ্যতা তার স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। ২০২০ সালে সাক্ষাৎকার-দাতা ꣲশ্যামাদাস বক্সী হঠাৎই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মহামারীর পরিস্থিতিতে যাতায়াত বন্ধ হলেও যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিলো। অপেক্ষায় ছিলুম কবে কলকাতায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে সবটুকু তাঁকে দেখিয়ে-শুনিয়ে নিশ্চিত হবো। মহামারীর কারণে সেটি সত্ত্বর সম্ভব ছিলো না বলে চলভাষে সে কাজটি সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। কিন্তু, মনে হয় তাঁর অসুস্থতার কারণে শেষের দিকে কিছু স্মৃতি-বিভ্রম দেখা দিয়েছিল। তাই শ্যামাদাস বাবুর খুড়তুতো দিদি, শ্রীমতী মিনতি ভট্টাচার্য-র শরণাপন্ন হই। শ্রীমতী ভট্টাচার্য কিছু প্রয়োজনীয় অংশ সংশোধন করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিলো সেই অংশগুলি শ্যামাদাস বাবুকে জানিয়ে সংশোধন করে নেবো, কারণ, পুরনো স্মৃতি তাঁকে মনে করিয়ে দিলে তিনি মনে করতে পারতেন! কিন্তু, তা আর সম্ভবপর হলো না। চলতি বছরের (২০২১) ১৮ আগস্ট, শ্যামাদাস বাবু নিজ বাসভবনে দেহত্যাগ করেছেন। ফলত তাঁর সাক্ষাৎকারটির বেশ কিছু অংশ পরিমার্জন করতে হলো। যেটুকু এখানে লিপিবদ্ধ হলো সেটুকু শ্রীমতী মিনতি ভট্টাচার্য ও শ্যামাদাস বাবুর জ্যাঠতুতো দিদি ꣲজয়ন্তী চক্রবর্তী-র ছোটমাসিমা, শ্রীমতী প্রণতী চক্রবর্তী, যাঁর ছেলেবেলা কুচবিহারে কেটেছে, — প্রয়োজনীয় অংশগুলি তাঁদের কাছে যাচাই করে তবেই পরিবেশন করা হলো। মূল সাক্ষাৎকারটিতে অস্ত্রোপচার হওয়ার কারণে কিছু অংশ ধারাবাহিকতা হারিয়েছিল। ভাব-সামঞ্জস্য রক্ষা করবার জন্য বন্ধনী, পাদটীকা ও টিপ্পনী-সহযোগে সেগুলি সংকলন করা হয়েছে। স্মৃতিতে ভুলে যাওয়া অংশগুলি প্রথম বন্ধনীর মধ্যে 'সংশোধন' বা সংক্ষেপে 'স' হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। শ্যামাদাস বাবু কখনও মুখে কিছু না বললেও এই সাক্ষাৎকারটি দানের জন্য বহু পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু, তাঁর জীবিতকালে এটি প্রকাশ করা সম্ভব হলো না। এটা ভীষণ যন্ত্রণায়ক। আশাকরি, বর্তমান সাক্ষাৎকারটি শ্যামাদাস বাবুর চোখে দেখা, অনুভব করা, উপলব্ধি-জাত স্থান-কাল-পাত্র-দের ইতিহাস ও অনুভুতি সুধী পাঠক ও গবেষক-দের মনে ও মননে চিত্রিত করতে সক্ষম হবে। অডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে গৃহীত শ্যামাদাস বক্সী-র সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত রেখে একত্রে পুরনো ভূমিকাসহ নীচে পরিবেশন করা হলো। (চিত্র নং ১)


চিত্র নং (১): শ্যামাদাস বক্সী (জন্ম: ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪০, কুচবিহার—মৃত্যু: ১৮ আগস্ট, ২০২১, সিঁথি, কলকাতা)।

ভূমিকা: যতদূর সম্ভব ২০১৭ সালের মে মাসের ঘটনা। সল্ট লেক নিবাসী জয়ন্তী দেবীর (ꣲজয়ন্তী চক্রবর্তী) কাছে জানতে পারলুম তাঁর খুড়তুতো ভাই শ্যামাদাস বক্সী সিঁথিতে থাকেন। সিঁথি মোড়ের কাছে। শুধুমাত্র ওইটুকু ঠিকানা সম্বল করে বেড়িয়ে পরলুম বাড়ি খুঁজতে। বৃষ্টিভেজা দিন! দীর্ঘক্ষণ হেঁটে যাচ্ছি, কোনো হদিস পাচ্ছি না। ঘটনাক্রমে হঠাৎ রাস্তায় একজন পোস্ট-ম্যানের সাথে দেখা। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে তিনি ঠিকানার কিছুটা আভাস দিতে পারলেন। এরপরেও খুঁজে পেতে দীর্ঘক্ষণ ঘুরতে হলো। অদ্ভুত বিষয় এতো ঘোরাঘুরি সত্ত্বে উৎসাহের বিন্দুমাত্র অভাব বোধ করছিলুম না। শেষে উৎসাহের জয় হলো, বাড়ি খুঁজে পেলুম। ফ্ল্যাটের আহ্বান-ঘণ্টায় চাপ পড়লো! তখনও বিস্ময়ের অপেক্ষা ছিলো। সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব চললো। কিন্তু অপরিচিত জায়গায় কোনো একজন অপরিচিত ব্যক্তি এসেছেন বলে বোধ হলো না! সেই থেকে প্রথম যাতায়াত শুরু। সাক্ষাৎকার পর্বের সূচনাও ওই সময়। সাক্ষাৎকার গ্রহণের উদ্দেশ্য বিবিধ। প্রথমত, শ্যামাদাস বাবুর পূর্বপুরুষরা প্রায় প্রত্যেকেই কুচবিহার রাজ-ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। দ্বিতীয়ত, তাঁদের পরিবারের কুচবিহারের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ক্রীড়া ও অন্যান্য বহুক্ষেত্রে অবদান রয়েছে, যে ইতিহাস আজ প্রায় বিস্মৃত। তৃতীয়ত, তাঁর নিজের চোখে দেখা কুচবিহারের পরিবেশ ও সংস্কৃতি। চতুর্থত, তাঁদের পরিবারের সাথে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পুরনো সংস্রবের কিছু টুকরো কথা। মূল সাক্ষাৎকারে প্রবেশ করবার পূর্বে শ্যামাদাস বাবু ও তাঁর বর্তমান পরিবার সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। শ্যামাদাস বাবু কুচবিহারের জেঙ্কিন্স স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করেছিলেন। পেশাগতভাবে তিনি দিল্লীর এসকর্ট কম্পানীতে টেকনিশিয়ানের পদে নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। তাঁর সহধর্মিণী সবিতা দেবী গৃহবধূ। (চিত্র নং ২) সবিতা দেবীর পিত্রালয় এন্টালির বখতিয়ার শা রোডে। তাঁর পিতা স্বর্গীয় শ্যামাপদ চক্রবর্তী, তিনি পেশায় কবিরাজ ছিলেন এবং মাতা স্বর্গীয়া অন্নপূর্ণা দেবী। বর্তমানে শ্যামাদাস বাবুরা ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী দু'জনে থাকেন। একমাত্র মেয়ে কাকলী রায় চৌধুরী কৃতী ছাত্রী। তিনি সপরিবারে ব্যাঙ্গালুরুতে আছেন। জামাই ঋষিন রায় চৌধুরী শাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের সন্তান। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের দুই সন্তান, মেয়ে আরাত্রিকা (কুটু) বড় এবং ছেলে অংশুমান (গুল্টু) ছোট। 


চিত্র নং (২). শ্যামাদাস বক্সী ও সবিতা দেবী (২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে বর্তমান সাক্ষাৎকার-গ্রহীতার ক্যামেরায়)

এবার শ্যামাদাস বাবু ও সবিতা দেবীর ব্যক্তিজীবনে আসা যাক। এই বিষয়ে ক'টি কথা উল্লেখ করবার আবশ্যকতা অনুভব করছি। তাঁদের জীবনধারা আর চার-পাঁচ জনের মতো নয়। উদয়-অস্ত ঘড়ি তাঁদের কথা শুনে চলে। অতএব, সব কিছুই তাঁদের গোছানো-নিপাট। তাঁদের বাড়িতে ঠাকুরসেবা রয়েছে। তাঁরা উভয়েই সেই সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে আনন্দ অনুভব করেন। ফ্ল্যাটের ছোট্ট একটি ঠাকুরঘরকে ঘিরে বাড়ি জুড়ে এক মন্দিরময় পরিবেশ। অভাগ্যতরাও সেই আবহ উপলব্ধি করবার সুযোগ পান। বেশ কিছু বছর হলো সবিতা দেবী তাঁর শ্রবণশক্তি একেবারে হারিয়েছেন। ফ্ল্যাটে তাঁরা দু'জনে থাকেন বটে, কিন্তু আকার-ইঙ্গিত ছাড়া পরস্পর কথা বলতে পারেন না, বরং বলা ভালো ওইভাবেই কথা বলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো অভাগ্যতদের প্রতি এতে তাঁদের আন্তরিকতার ন্যূনতম হ্রাস ঘটেনি।

এখানে সামান্য কয়েকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অবতারণা ঘটিয়ে সাক্ষাৎকারে প্রবেশ করবো। সাক্ষাৎকারটি যেকারণে গ্রহণ করা হয়েছে তার সাথে এসমস্ত কথার প্রত্যক্ষ কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু, এই অভিজ্ঞতাগুলি সাক্ষাৎকারটিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করবে বলে মনেহয়। দ্বিতীয়বার শ্যামাদাস বাবুর বাড়িতে যখন আগে থেকে জানিয়ে গিয়েছিলুম তিনি পরের দিন দেখা হ'বে বলে উদ্বেগে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেছেন। একবার তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে গিয়েছি, সেই রান্নার স্মৃতি-সুগন্ধ-সুরস যেন সৎচরিত্র ভূতের মতো এখনও তাড়া করে বেড়ায়! শ্যামাদাস বাবুরা নিশিভোরে ওঠেন, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। আরও একবার সন্ধ্যায় একটু দেরি করে গিয়েছি। দেখা হয়নি। সেবার বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনে ছিলুম। আবার এক বিনিদ্র রাত্রি যাপন করে সাত-সকালে শ্যামাদাস বাবু প্যাকেট ভরা সন্দেশ নিয়ে দেখা করবার জন্য সেখানে হাজির। বর্তমানে শ্যামাদাস বাবু শয্যাশায়ী। এই সময়েও প্রশ্নের শাণিত আঘাত থেকে তাঁকে রেহাই দেইনি। তাঁদের মন্দিরের নিঃসীম শান্ততা তাঁদের স্বভাবের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে। কাজেই এই অবস্থাতেও সামান্যতম বৈলক্ষণ নেই, বিরক্তি নেই। সবই যেন ভালোবাসা ও আনন্দ-মোড়া। তাঁরা দু'জনেই বিষয়-আশয়ের প্রতি যথেষ্ট উদাসীন। অতএব, শ্যামাদাস বাবুর মুখে তাঁদের জমিদারী, আভিজাত্য ও অন্যান্য আত্ম-গরিমা-সূচক বিষয়-বস্তু নিয়ে আসা তেমন একটা সম্ভব হয়নি। একার্থে তিনি সেরকম কিছুই বলেননি। এই ক্ষেত্রগুলিতে মূলত গল্প শুনে ও পড়ে (মুদ্রিত ও অমুদ্রিত সূত্র-সমূহ থেকে) ব্যক্তিগতভাবে সামান্য যা কিছু জানা ছিলো, কেবল সেগুলির সম্মতি ও অসম্মতি গ্রহণ করেছি মাত্র। সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপ —

প্রঃ: আপনার নাম? 

উঃ: শ্যামাদাস বক্সী। 

প্রঃ: আপনার বাবা ও মায়ের নাম কি? 

উঃ: বাবা — স্বর্গীয় সুধাংশুমোহন বক্সী, মা — স্বর্গীয়া গৌরী দেবী। 

প্রঃ: আপনার জন্ম কতো সালে এবং কোথায়? 

উঃ: ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪০ সাল, সোমবার, কুচবিহার।

প্রঃ: আপনাদের কুচবিহারের পরিবারের প্রসঙ্গে প্রবেশ করবার আগে যদি আপনার দাদুর বাড়ির সম্বন্ধে কিছু বলতেন?

উঃ: দাদু-দিদার নাম আমার মনে নেই। তাঁদের আমি দেখিনি। শুধুমাত্র এটুকু বলতে পারবো দাদুর বাড়ির পদবী ছিলো বন্দ্যোপাধ্যায়। দাদু ছিলেন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়-বংশের সন্তান।

প্রঃ: আপনার বাবা-রা ক'ভাই-বোন ছিলেন? 

উঃ: বাবা-রা পাঁচ ভাই ও আট বোন ছিলেন। বাবা ছিলেন ভাইদের মধ্যে সব থেকে ছোট। পিসিদের মধ্যে আমি শুধুমাত্র চপলা পিসিমা (ꣲচপলা মুখার্জী) ও বিজলী পিসিমা (ꣲবিজলী মুখার্জী)-কে দেখেছি, অন্যান্যরা আগেই গত হয়েছিলেন। 

প্রঃ: আপনার বাবা ও মা কি নিয়ে পড়াশুনো করেছিলেন?

উঃ: বাবা কুচবিহার জেঙ্কিন্স স্কুলের ছাত্র ছিলেন (!)। তিনি পরবর্তীতে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বি.ই. পাশ করেছিলেন। মায়ের পড়াশুনো কলকাতায়। তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু পাস করেছিলেন কিনা বা ওই বিষয়ে আর কিছু বলতে পারবো না। 

প্রঃ: আপনারা ক'ভাই-বোন? 

উঃ: আমাদের যৌথ পরিবার ছিলো, কাজেই আমরা অনেক-জন ভাই-বোন। সেখানে কোনো আপন-পর ছিলো না, আজও নেই। যদি সহোদর বলতে হয় তবে আমার দিদি ছিলেন, স্বর্গীয়া সুজাতা বক্সী। দিদি আমার থেকে বয়সে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন (জন্ম: ১৯৩৫ সাল)।

প্রঃ: আপনার দিদির সম্বন্ধে যদি কিছু বলতেন?

উঃ: দিদি সুনীতি অ্যাকাডেমীর ছাত্রী ছিলেন, তিনি সেখান থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করেছিলেন (১৯৫৪ সাল)। তারপর তিনি কুচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে (বর্তমানে 'আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়') পড়াশুনো করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলকাতার একটি কলেজ (নাম মনে নেই) থেকে সম্ভবত বাংলায় অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েসন করেছিলেন। তাঁর বিবাহ হয়েছিল ꣲঅমল মুখার্জীর সাথে। জামাইবাবু কলকাতা পুলিশে ইন্সপেক্টর ছিলেন, একসময় লালবাজারে পোস্টেড ছিলেন। বর্তমানে দিদি-জামাইবাবু দু'জনেই গত হয়েছেন, তাঁদের এনটালির সুরেশ সরকার রোডে বাড়ি। তাঁদের দুই মেয়ে, বিবাহিত। 

প্রঃ: আপনাদের পরিবার কুচবিহারের চার ঘর প্রধান জমিদারদের মধ্যে অন্যতম ছিলো। আপনার ঠাকুরদা স্বর্গীয় রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সী একসময় মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ-এর সাম্মানিক এ.ডি.সি (এডি-ডি-ক্যাম্প/পার্শ্বসহচর) ছিলেন, তিনি দীর্ঘকাল কুচবিহার টাউন কমিটির (বর্তমানে কুচবিহার পৌরসভা) সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর বহু কীর্তি আজও কুচবিহার জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, ব্যক্তি হিসেবে তিনি কি রকম ছিলেন?

উঃ: ঠাকুরদা-কে আমি দেখিনি। (চিত্র নং ৩) তিনি আমার জন্মের আগেই গত হয়েছিলেন। তিনি দত্তকপুত্র ছিলেন।


চিত্র নং (৩). রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সী (জন্ম: ১০ অক্টোবর, ১৮৬৩, শনিবার—মৃত্যু: ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সাল, মঙ্গলবার, কুচবিহার)।

সম্ভবত বিষ্ণুপুর (বাঁকুড়া জেলা) থেকে তাঁকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। কুচবিহার রাজপরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তাঁর ব্যক্তিত্বও ছিলো রাজকীয়। তিনি গম্ভীর এবং ধার্মিক-প্রকৃতির ছিলেন। বাবা ও জ্যাঠামশাইরা তাঁকে খুব ভয় পেতেন। বড় জ্যাঠামশাই (রায় সাহেব ꣲললিতমোহন বক্সী) খুব ব্যক্তিত্বশালী ছিলেন, ঠাকুরদার সামনে তিনিও ভয়ে কাঁপতেন ও হাত-জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। (চিত্র নং ৪)



চিত্র নং (৪). রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সী ও রাজমোহিনী দেবীর পরিবার: ডান থেকে বা-দিকে — প্রথম সারিতে বসে: মনোজমোহন বক্সী (নন্দ), প্রীতিরাণী দেবী (ডলি), মিনতি দেবী (শেলু), দিলীপমোহন বক্সী; দ্বিতীয় সারিতে বসে: নীলিমা দেবী (লিলি), কমলা দেবী, রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সী, লীলাবতী দেবী, পূর্ণিমা দেবী; পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে: মোহিনীমোহন বক্সী (মণি), নলিনীমোহন বক্সী (কাশী) ও ললিতমোহন বক্সী। আলোকচিত্রটি আনুমানিক ১৯৩৭-১৯৩৮ সালে গৃহীত। পরিচিতি: রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সী ও রাজমোহিনী দেবীর জ্যৈষ্ঠ কন্যা ছিলেন লীলাবতী দেবী, শরৎচন্দ্র ঘোষাল-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়েছিল; ললিতমোহন বক্সী ও পূর্ণিমা দেবীর জ্যৈষ্ঠ সন্তান ছিলেন মনোজমোহন (অকালপ্রয়াত), নলিনীমোহন বক্সী ও কমলা দেবীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন দিলীপমোহন, মোহিনীমোহন বক্সী ও নীলিমা দেবীর প্রথমা ও দ্বিতীয়া কন্যা প্রীতিরাণী ও মিনতি।

প্রঃ: আপনাদের কুচবিহারের বাড়িটি রাজ-আমলের অন্যতম আধুনিক ও সুসজ্জিত বাড়ি ছিলো, কি রকম ছিলো এই বাড়িটি ও তার চত্বর?  

উঃ: শুনেছি একসময় আমাদের কাঁচা বাড়ি ছিলো। বাড়িটি বেশ কয়েকবার আগুন লেগে পুড়ে যায়। এতে বহু ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। প্রতিবার নতুন করে বাড়ি বানাতে হয়েছিল। তাই ঠাকুরদা নিজের মতো করে পাকা বাড়িটি বানিয়ে ছিলেন। আমাদের কুচবিহারের বাড়ির মূল গেটটি ছিলো (এখনও রয়েছে) উত্তরদিকে, এটি ঠাকুরদার আমলে তৈরী, তার পূর্বদিকে দু'পাশে দুটি খুঁটির ওপর অশোক স্তম্ভ (চারটির পরিবর্তে তিনটি সিংহ-বিশিষ্ট) দেওয়া গেটটি বাবা অনেক পরে বানিয়ে ছিলেন। বাড়ির সদর দরজা খুললেই, একদম সরলরেখা বারবার মূল গেট হয়ে বৈরাগী দীঘির দক্ষিণদিকের ঘাট পেড়িয়ে উত্তরের চাঁদনী থেকে ꣲশ্রীꣲশ্রী মদনমোহন ঠাকুর-এর দর্শন হতো। (চিত্র নং ৫) মূল গেট দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে হাতের বা-দিকে প্রথমেই ছিলো অর্কিড হাউস ও তৎসংলগ্ন বাগান, তারপর (পূর্বদিকে) ছিলো গ্যারেজ। গ্যারেজটি আদতে ছিলো পিলখানা।


চিত্র নং (৫). ১৯৫৪ সালের বড় বন্যায় জলমগ্ন বক্সী বাড়ির মূল দালান ও প্রাঙ্গণ। ছবিটির একদম ডান-দিকে বক্সীদের কাছারি বাড়ি দেখা যাচ্ছে।

আমাদের মূল দালানের দক্ষিণদিকে ছিলো উঠোন। উঠোনটি পাকা ছিলো। উঠোনের দক্ষিণ-পূর্বদিকে ছিলো আমাদের পড়ার ঘর। তার পূর্বদিকে গোল, পাকা করে বাঁধানো একটি পুরনো বেল গাছ ছিলো। উঠোনের দক্ষিণ-পূর্বদিকে ছিলো পুকুর (আংশিক এখনও রয়েছে!)। পুকুরের পশ্চিমপারে মাঝ-বরাবর মোটামুটি-ভাবে বড় একটি পাকা ঘাট ছিলো। যে বেল গাছটির কথা বললুম, সেটি ওই পুকুর আর পড়ার ঘরের প্রায় মাঝামাঝি ছিলো। উঠোনের দক্ষিণদিকে ছিলো রান্নাঘর, তারও দক্ষিণে
অর্থাৎ বাড়ির পেছনেদিকে ছিলো গোয়াল ঘর ও আস্তাবল।

বাড়ির পশ্চিমদিকে ছিলো কাছারি বাড়ি যার প্রবেশপথ ছিলো বিশ্বসিংহ রোডের দিকে। সেদিকে দু'পাশে স্তম্ভ দেওয়া একটি গেট এবং খিলান দেওয়া বড় পুল (এখনও বর্তমান) ছিলো। (চিত্র নং ৬)



চিত্র নং (৬). বিশ্বসিংহ রোডের পূর্বদিকে অবস্থিত বক্সীদের কাছারি বাড়ির পুল। বহু স্মৃতিবিজড়িত খিলান দেওয়া এই পুলটি রাজ-আমলে কুচবিহার অঞ্চলের কালভার্ট নির্মাণ-শিল্পের একটি অবশিষ্ট নিদর্শন; কুচবিহারে এধরণের অধিকাংশ কালভার্টই ভাঙা পড়ে গিয়েছে।

প্রঃ: আপনাদের এই মূল দালানটি কিরকম ছিলো? 

উঃ: দালানটি ছিলো অনেকটা ইংরেজীর 'L' অক্ষরের মতো। এর মুখ্য প্রবেশপথটি ছিলো উত্তরদিকে, যেদিকে মাঝ-বরাবর অনেকটা গোল মতো (স: আয়তাকার, পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ) বারান্দা ছিলো। দালানটি উত্তর-পশ্চিমদিকে প্রসারিত ছিলো।

প্রঃ: মূল দালানের ভেতরটি কি রকম ছিলো?

উঃ: দালানের মাঝ-বরাবর 'বৈঠকখানা' ঘর ছিলো, সেখানে fire place ছিলো। বৈঠকখানা সংলগ্ন পশ্চিমদিকের ঘরটিতে ঠাকুরদার লাইব্রেরী ছিলো। (চিত্র নং ৭) এমনিতে ঘরগুলি বিভিন্ন রকম শৌখিন আসবাব, মূর্তি, তৈলচিত্র প্রভৃতি দিয়ে সাজানো ছিলো। মনে পড়ে বৈঠকখানা ঘরে শিকার করা একটি কালো লেপার্ড স্টাফ করে রাখা ছিলো। এছাড়া বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় অন্যান্য অনেক ট্যাক্সিডার্মি সাজানো ছিলো।


চিত্র নং (৭). রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সীর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের শীলমোহর; বর্তমানে এই গ্রন্থাগারের কিছু অংশ কোচবিহার সাহিত্য সভায় সংরক্ষিত।

প্রঃ: দীর্ঘকাল আপনার ঠাকুরদার তত্ত্বাবধানে কুচবিহারের নরেন্দ্র নারায়ণ পার্ক, গোল বাগান (হিতেন্দ্র নারায়ণ পার্ক?) প্রভৃতি পরিচালিত হয়েছিল। শুনেছি আপনাদের বাড়ির অর্কিড হাউস কুচবিহারের একটি দর্শনীয় স্থান ছিলো, বাড়িতে বড় বাগান ছিলো, এ সম্বন্ধে আপনার স্মৃতি যদি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতেন?

উঃ: ঠাকুরদাকে আমি দেখিনি, সেকথা আগে বলেছি, তবে তাঁর বাগান করবার শখ সম্বন্ধে শুনেছি। তাঁর বানানো বাড়ির বাগান ও অর্কিড হাউস দেখেছি। অর্কিড হাউসটিকে বলা হতো
'হট হাউস'।

প্রঃ: কি রকম ছিলো এই অর্কিড হাউসটি?

উঃ: অর্কিড হাউস-টি ১৯৪৮-১৯৫০ সাল নাগাদ আমি যখন দেখেছি (তারপর মনে নেই) তখন যত্নের অভাবে সেটি ভগ্নপ্রায়। হাউসটি ছিলো আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। ঘরটিতে প্রবেশের জন্য সামনে (পূর্বদিকে) ও পেছনে (পশ্চিমদিকে) সম্ভবত পাঁচটি ধাপযুক্ত সিঁড়ি ছিলো। ঘরটির ভিত মাটি থেকে প্রায় ৫ ফিটের মতো উঁচু ছিলো, কক্ষটির মাপ ছিলো প্রায় ৪০' x ২০-২৫' x ১৫' মতো। অর্থাৎ, ঘরটি মাটি থেকে প্রায় ২০ ফিটের মতো উঁচু ছিলো। মেঝে পাকা, কাস্ট আইরনের খুঁটির উপর টিনের দোচালা। ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্ররণের জন্য টিনের নীচে খড় দেওয়া ছিলো। ঘরের দেওয়ালগুলি ছিলো কাঠের ওপর কাঁচ বসানো, যেমন গ্রীন হাউস-গুলি হয়ে থাকে। আমরা যখন দেখেছি তখন তার অনেক কাঁচ ভেঙে গিয়েছে। ঘরটির দৈর্ঘ্য
বরাবর দু'সারিতে তার দিয়ে মাটির টব ঝোলানো ছিলো। টবগুলির মধ্যে চারকোল দিয়ে অর্কিড লাগানো ছিলো। শুনেছি অর্কিডগুলি বেশীরভাগই দার্জিলিং ও সিকিম থেকে আনা হয়েছিল, বিদেশী অর্কিডও ছিলো।

প্রঃ: ঘরটিতে কি থার্মোমিটার ও ব্যারোমিটার বসানো ছিলো?

উঃ: ঠিক মনে নেই।

প্রঃ: ঘরটি কবে ভাঙা হয়েছিল?

উঃ: মনে নেই।

প্রঃ: বাড়ির অন্যত্রও কি বাগান ছিলো? 

উঃ: বলতে গেলে ঠাকুরদার বাগান করবার শখের জন্য আমাদের বাড়ির চারদিকেই বাগান ছিলো। বাড়িতে প্রবেশ করতে বা-দিকে অর্কিড হাউস ও গ্যারেজের কাছে ছিলো ঠাকুরদার আমলের গোলাপ বাগান। বাবা-র গোলাপের খুব শখ ছিলো। গোলাপ বাগানে বিভিন্ন প্রকারের গোলাপ ছিলো। 'পল নিরন', 'ব্ল্যাক প্রিন্স' এই দু'টির নাম মনে আছে।

ওই গোলাপ বাগানের দক্ষিণ-পূর্বদিকে ছিলো লন। বাড়ির অন্যত্রও লন ছিলো, কিন্তু পূর্বদিকের ওই লনটিই ছিলো well maintained। লনগুলি ঠাকুরদার আমলের। তিনিই এসবের তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি লন maintain করবার জন্য কাস্ট-আইরনের হ্যান্ড-রোলার, লন-মোয়ার কিনে ছিলেন। আমরা যখন দেখেছি সেজো জ্যাঠামশাই (ꣲমোহিনীমোহন বক্সী) মূলত লন রক্ষণাবেক্ষণের তত্ত্বাবধান করতেন, বাবাও দেখাশোনা করতেন।

বাড়ির পূর্বদিকে, পুকুরের উত্তর-পারে ছিলো সব্জি বাগান। এই বাগানটিও ঠাকুরদার সময়কার। ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিট, গাজর প্রভৃতি সব্জি চাষ হতো সেখানে। অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ চাষ হলেও আলু চাষ সেখানে একদমই হতো না। বাবা এসব তত্ত্বাবধান করতেন, এছাড়া দেখাশোনার জন্য লোক তো ছিলোই। সাধারণত কলকাতার 'সাটন' ('সাটন অ্যান্ড সন্স লিঃ') থেকে অর্ডার দিয়ে ডাকযোগে সব্জির বীজ নিয়ে আসা হতো। ওই সব্জি বাড়ির দুর্গা পুজোর ভোগে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৪৩-১৯৪৪ সাল নাগাদ বাড়ির সব্জি সম্ভবত কুচবিহার রাস মেলায় আয়োজিত প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছিল, পুরষ্কারও পেয়েছিল। 

বাড়ির পশ্চিমদিকে এবং পশ্চিমে কাছারি বাড়ির উত্তরদিকে অর্থাৎ হিতেন্দ্র নারায়ণ রোডের দক্ষিণেও ফুল বাগান ছিলো। সেজো জ্যাঠামশাই থাকতেন বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমদিকের অংশে। সেদিকটিতে ছিলো নারকোল, কুল, করমচা এসব গাছের বাগান। বাড়ির পেছনে অর্থাৎ দক্ষিণে যেদিকে পিপল্স ব্যাংক ('পিপল্স ব্যাংক লিঃ') ছিলো তার উত্তরদিকের জমিতে ছিলো আম, জাম পেয়ারা, আনারস প্রভৃতির বড় বাগান। এই বাগানটিকে মোটামুটি ফলের বাগান বলা যায়। খুব ভালো পেয়ারা হতো, ভেতরটি ছিলো লাল, ওগুলিকে 'কাশীর পেয়ারা' বলতে শুনেছি। 

প্রঃ: বাড়ির বাগানে এছাড়া কি কি গাছ ছিলো?

উঃ: বাড়ির বাগানে ভূর্জপত্র, দারুচিনি, পান্থপাদপ, রক্তচন্দন প্রভৃতি; ফলের মধ্যে লিচু, কাঁঠাল, পেপে, জলপাই, আঙুর, খেজুর প্রভৃতি আরও যে কতো রকম গাছ ছিলো এতোদিন পর আমি তা ভালোভাবে বলতেও পারবো না। ভূর্জপত্র গাছটি ঠাকুরদা হিমালয়ের কোনো অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সেই গাছের বাকল ছাড়িয়ে আমরা কাগজ করে অনেক কিছু লিখেছি। দারুচিনি বাকল ছাড়িয়ে খেয়েছি। আঙুর ও খেজুর গাছগুলি বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, তাই ঠাকুরদা তাদের জন্য পরীক্ষামুলকভাবে আফগানিস্তান অঞ্চল থেকে মাটি আনিয়েছিলেন যাতে ফলন ভালো হয়। কিন্তু আমি খেয়ে দেখেছি আঙুর টক ছিলো, বোধহয় আবহাওয়ার জন্য।

প্রঃ: বাড়িতে আর কারোর কি বাগান করবার শখ ছিলো?

উঃ: বড় জ্যাঠামশাইয়ের বাগানের শখ ছিলো, তবে অল্প। তাঁর বাড়ির (বর্তমানে কুচবিহার জেলা পরিষদ ভবন) দক্ষিণদিকে অর্থাৎ কালিকাদাস রোডের দিকে ছিলো বাগান। যদিও সেই বাগানটি আমাদের পুরনো বাড়ির বাগানের সাপেক্ষে অনেক ছোট ছিলো।

প্রঃ: আপনি বাড়িতে একটি পিলখানার কথা বললেন, পরবর্তীতে যেটিকে গ্যারেজে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, কি রকম ছিলো এই পিলখানা? 

উঃ: বাড়িতে ঢুকতে বাদিকে অর্কিড হাউসের পর (পূর্বদিকে) বাগানের কাছাকাছি ছিলো পিলখানা। পিলখানাটি ছিলো পশ্চিমমুখী, সেখানে পাকা-মেঝেযুক্ত, কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরী, দোচালা, উঁচু, পরপর বিরাট চারটি ঘর ছিলো। দরজাগুলিও ছিলো কাঠের ফ্রেম করা টিনের দরজা। সেখানে ঠাকুরদার হাতী থাকতো। তাঁর তিনটি হাতী ছিলো। তবে, আমি যখন দেখেছি তখন একটি মাত্র হাতী ছিলো। খুব ছোট তখন আমি। পরে সেই হাতীটিকে বিক্রী করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নাম ছিলো 'লক্ষ্মী'। পিলখানার দক্ষিণদিকে একদম শেষের ঘরটিতে সে থাকতো। মেয়ে হাতী শান্ত হয় বলে তাঁদের সহজে পোষ মানানো যায়। হাতী বিক্রীর পর ঘরটিকে গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পিলখানা উঠে যাওয়া ও জমিদারী বিভাজনের পর একদম উত্তরদিকের প্রথম ঘরটিতে তহশীলদারের অফিস হয়েছিল। শেষ যিনি তহশীলদার ছিলেন তাঁর নাম ছিলো বিনয় বাবু, তাঁর পদবী সম্ভবত 'রায়' ছিলো।

প্রঃ: শুনেছি রাজবাড়ির পর কুচবিহারে প্রথমদিকে যে বাড়িগুলিতে গাড়ী এসেছিল তার মধ্যে আপনাদের বাড়ি অন্যতম, আপনাদের কি গাড়ী ছিলো? 

উঃ: ঠাকুরদার গোটা তিনেক গাড়ী ছিলো, প্যানহার্ড, অস্টিন এই দুটির কথা মনে আছে। (চিত্র নং ৮) পরে বাবা কুচবিহারে থাকতে একটি ফোর্ড ভি.এইচ. কিনেছিলেন। মা গাড়ী চালানো শিখতে শুরু করেছিলেন, তবে সম্পূর্ণ করেননি। এছাড়া আমি যখন দেখেছি তখন আমাদের একটি ঘোড়ার গাড়ী ছিলো। মডেলের নাম মনে নেই। বক্সের মতো। দুটি বাদামি ঘোড়া ছিলো। বাড়ির পেছনে আস্তাবলের কথা আগে বলেছি, সেখানে ঘোড়া দুটি থাকতো। যতদূর মনে পড়ে কাছারি বাড়ির পেছনদিকে গাড়োয়ান-এর থাকবার জায়গা ছিলো।


চিত্র নং (৮). রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সীর 'প্যানহার্ড' (!) গাড়ী; গাড়ীর সামনে ভর দিয়ে সম্ভবত নলিনীমোহন বক্সী দাঁড়িয়ে রয়েছেন; আনুমানিক ১৯২৫-১৯৩৫-এর দশকে গৃহীত অলোকচিত্র।

প্রঃ: আপনাদের বাড়ির পেছনদিকে পিপল্স ব্যাংক-এর কথা বললেন, বাড়িটি কি আপনাদের ছিলো?

উঃ: না আমাদের ছিলো না। বাড়িটি কার বা কাদের ছিলো সেকথাও বলতে পারবো না।

প্রঃ: বাড়িটি এখন আর নেই। কী রকম ছিলো ওই বাড়িটি?

উঃ: (বাড়িটি আর নেই শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।) বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে মাঠ ছিলো। সাদা রঙের বড় দোতলা বাড়ি, সামনে থাম দেওয়া গাড়ী-বারান্দা।

প্রঃ: ফিরে আসি আপনাদের বাড়ির প্রসঙ্গে, আপনাদের কাছারি বাড়িটি কি রকম ছিলো? 

উঃ: কাছারি বাড়িটি বেশ বড় ছিলো। কাঠের বাড়ি, কাঠের প্ল্যান্কিং-যুক্ত মেঝে, টিনের চৌচালা।

প্রঃ: আপনাদের কোন কোন অঞ্চলে জমিদারী ছিলো?

উঃ: সঠিক বলতে পারছি না। ১৯৪৭ সালের আগে কোনো একসময় জমিদারী বিভাজনের পর দিনহাটা, শীদলখুঁচি প্রভৃতি অঞ্চলে বাবার অংশ পড়েছিল। শীদলখুঁচিতে মেজো জ্যাঠামশাইয়ের (ꣲনলিনীমোহন বক্সী) অংশও ছিলো। আমাদের আদিনিবাস ছিলো রংপুরের নাওডাঙ্গায় (বর্তমান বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত)। সেখানকার জমিদারীটি সেজো জ্যাঠামশাইয়ের অংশে পড়েছিল। (চিত্র নং ৯.১-৯.২)





চিত্র নং (৯.১-৯.২). — (৯.১). ১৩১৬ বঙ্গাব্দে (১৯০৯-১৯১০ খ্রীঃ) মাতা প্রসন্নময়ী দেবী-র পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে রায় চৌধুরী মনোমোহন বক্সী বৈরাগী দীঘির দক্ষিণদিকের এই ঘাটটি নির্মাণ করেছিলেন; (৯.২). ঘাটের উৎসর্গ-ফলক (আংশিক পরিবর্ধিত)।

প্রঃ: আপনাদের বাড়িতে একসময় দুর্গা পুজো হতো, সেই স্মৃতি আপনার কিছু মনে আছে? 

উঃ: হ্যাঁ, আদতে পুজোটি নাওডাঙ্গার বাড়িতে হতো। সেখানে ঠাকুরদালান ছিলো শুনেছি। তবে আমি কখনও নাওডাঙ্গায় যাইনি, কাজেই সে পুজো কখনও দেখবার সুযোগ হয়নি। আমি যে সময়কার কথা বলছি তখন মূলত আমার সেজো জ্যাঠামশাই পুজোর তত্ত্বাবধান করতেন। যতদূর মনে পড়ছে ১৯৪৬ সাল থেকে সেই পুজোটি কুচবিহারের বাড়িতে শুরু হয়েছিল। পিলখানার উত্তরদিকের প্রথম ঘরটি বাদ দিয়ে, বাকি তিনটি ঘরের টিনের পার্টিশন দু'টি খুলে নিয়ে তিনটি ঘর মিলিয়ে পুজোর আয়োজন করা হতো।

প্রঃ: বিল্ববরণ কোথায় হতো?

উঃ: বাড়ির পূর্বদিকে পুকুর পারে যে পুরনো বেল গাছটির কথা আগে বললুম, তার নীচেই বিল্ববরণ হতো।

প্রঃ: প্রতিমা কিসের ওপর স্থাপন করা হতো? প্রতিমা সম্বন্ধে আপনার যা মনে আছে যদি বলতেন?

উঃ: আনুমানিক একটি ৮' x ৩' x ২' মাপযুক্ত কাঠের চৌকির ওপর একচালা প্রতিমা স্থাপন করা হতো। শুধুমাত্র প্রতিমার উচ্চতা হতো প্রায় আট ফিটের মতো, চালচিত্র মিলিয়ে আনুমানিক মোট দশ ফিটের মতো উচ্চতা হয়ে থাকবে। মাঁ দুর্গার মুখের রঙ বড়দেবীর (কুচবিহার) মতো এতোটা লাল হতো না, তবে অনেকটা লালচে-গোলাপী হতো (স: অতশী বর্ণা)। প্রতিমা কে নির্মাণ করতেন মনে নেই, তোর্ষা নদীর কাছাকাছি কোনো একজায়গায় তিনি থাকতেন। স্মৃতিতে যেটুকু ভেসে ওঠে মাঁয়ের অলঙ্কার ও অস্ত্র সাধারণ ছিলো, অর্থাৎ সোনা বা রুপোর কিছু ছিলো না। (চিত্র নং ১০)



চিত্র নং (১০). বক্সী বাড়ির পুজোয় ব্যবহৃত ১৯০৬ সালে 'মৎস্য-পুরাণ' মতে জনৈক মদনমোহন দেবশর্মা-র অনুলিখিত দুর্গাপুজো-পদ্ধতি পুথির একটি পত্র।

প্রঃ: পুজোয় ব্যবহৃত দেবীর ঘট, অন্যান্য বাসন-পত্র কি রকম ছিলো? 

উঃ: দেবীর ঘটটি ছিলো রুপোর, উচ্চতা প্রায় ৬"-৭", ভারি। পুজোয় ব্যবহারের জন্য প্রচুর রুপোর বাসন বেরুতো, যেমন — পরাৎ, কুজো, বিভিন্ন মাপের রেকাবি, গ্লাস (যেগুলির কোনো কোনোটিতে আবার ঢাকনা দেওয়া) প্রভৃতি। পুজোর বাসন সবই প্রায় রুপোর, বড় বড় ও ভারি। কোনো কোনোটিতে খুব সুন্দর কারুকার্য করা ছিলো।

প্রঃ: ভোগ কোথায় রান্না হতো? কি রকম ভোগ হতো?

উঃ: গ্যারেজের পর অর্থাৎ দক্ষিণদিকে ছিলো ভোগঘর। সেখানেই চারটি বড় বড় উনুনে ভোগ রাঁধবার ব্যবস্থা ছিলো। দেবীর নিরামিষ ও আমিষ দু'রকমের ভোগ হতো। 

প্রঃ: পুজো উপলক্ষ্যে কোনো বিশেষ রান্না হতো?
 
উঃ: রান্নার বহর ছিলো, কিন্তু কোনো বিশেষ রান্না হতো কিনা তা আজ আর মনে নেই। পুজোতে আত্মীয়-সজনরা সকলে আসতেন। খুব হই হই হতো, বিশেষ বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন থাকতো, পুজোর সময় যেমনটি হয়। 

প্রঃ: আপনি বললেন দেবীর আমিষ ভোগ রান্না হতো অর্থাৎ বলি হতো? 

উঃ: হ্যাঁ। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন ছাগ বলি হতো।

প্রঃ: নিরঞ্জন কি ভাবে ও কখন হতো? 

উঃ: বড়দেবী বাড়ি ও ঠাকুর বাড়ির প্রতিমা যখন নিরঞ্জনের জন্য বেরুতো সাথে রাজকীয় ব্যান্ড যেতো। ওই দুটি প্রতিমা ও অন্যান্য প্রতিমার সঙ্গে ঢাক ও অন্যান্য বাদ্য-সহযোগে বাড়ি থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য বেরুতো। প্রতিমা ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া হতো। তোর্ষায় নিরঞ্জন হতো, আমি কয়েকবার গিয়েছি। নিরঞ্জনের আগে দুটি বড় নৌকো জোড়া দেওয়া হতো। আমাদের কুচবিহারে ওরকম জোড়া-নৌকোকে 'মার' বলে। প্রতিমা ওই মারের ওপর স্থাপন করে, মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে মারটিকে সাত পাক ঘোরানো হতো। তারপর সন্ধ্যার আগে এই বিকেল ০৪:০০-০৪:৩০ নাগাদ প্রতিমা নিরঞ্জন হতো। আমাদের প্রতিমার কাঠামো ফেরত নিয়ে আসবার চল ছিলো না, কাঠামো সমেত নিরঞ্জন হতো। সম্ভবত ১৯৪৮ সালে শেষবার প্রতিমা পুজো হয়েছিল অর্থাৎ কুচবিহারে মোট তিন বছর পুজো হয়েছিল।

(তোর্ষার কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিচারণ করে বললেন — ) হায়! হায়! কতোদিন ওই নদীর ধারে ব্রীজের (রেলসেতু) কাছে বসে থেকেছি। কুচবিহারে আমার জীবনের ওইটুকু সময়ের মধ্যেও তোর্ষার অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।

প্রঃ: প্রতিমা পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কি ঘটে পুজো হয়েছিল?   

উঃ: হ্যাঁ, এরপর ওই একই জায়গায় ঘটে পুজো হয়েছে। আয়োজন একই রকম ছিলো, তবে একটু ছোট পরিসরে। সম্ভবত ঘটে তিনবার পুজো হওয়ার পর পুজোটি আনুমানিক ১৯৫১ সাল নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়। ঘটে পুজোর সময় বলি হয়নি। দেবীর ওই ঘটটি সম্ভবত কুচবিহারের ব্রহ্মচারী কালীবাড়িতে দেওয়া হয়েছিল।(১) (চিত্র নং ১১.১-১১.৪)








চিত্র নং (১১.১-১১.৪). বর্তমানে কুচবিহারের ব্রহ্মচারী কালীবাড়িতে স্থাপিত বক্সী পরিবারের কুলবিগ্রহ — (১১.১). ꣲশ্রীꣲশ্রী দয়াময়ী; (১১.২). ꣲশ্রীꣲশ্রী দয়াময়ী (আংশিক পরিবর্ধিত); (১১.৩). ꣲশ্রীꣲশ্রী শ্যামসুন্দর ও ꣲশ্রীꣲশ্রী মনোমোহিনী (শ্রীরাধিকা), (কোন শালগ্রাম শিলা-গুলি বক্সী পরিবার সূত্রে এসেছে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন); (১১.৪). ꣲশ্রীꣲশ্রী শ্যামসুন্দর ও ꣲশ্রীꣲশ্রী মনোমোহিনী (আংশিক
পরিবর্ধিত) ।

প্রঃ: বাড়িতে আর কি কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান হতো?

উঃ: পুণ্যা হতো।

প্রঃ: এই বিষয়ে আপনার কোনো স্মৃতি আছে? 

উঃ: হ্যাঁ। অনুষ্ঠানটি কাছারি বাড়িতে হতো। মোট দু'বার পুণ্যায় বসেছি বলে মনে আছে। ১৯৪৪-১৯৪৫ সাল নাগাদ, আমার তখন চার-পাঁচ বছর বয়স। লাল রঙের সোনালী জরি করা একটি আসনের ওপর গোলাপী পাঞ্জাবি (জরি করা পাঞ্জাবি, সোনার বোতাম দেওয়া), মুগা রঙের হলদেটে ধুতি (জরির পার দেওয়া) ও মাথায় গোলাপী টুপি (জরি-যুক্ত) পরে বসেছিলুম; আসন, বস্ত্র, টুপি সবই ছিলো মখমলের। পুণ্যার সময়ও প্রচুর রুপোর বাসন বেরুতো, সেগুলির কারুকার্যও ছিলো দেখবার মতো। রুপোর আতরদান, গোলাপপাশ প্রভৃতি যেমন বেরুতো, তেমনি ক্রিস্টালের আতরদান, গোলাপপাশ প্রভৃতি শৌখিন জিনিসপত্র থাকতো। তখন এসব বুঝিনি, খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে, এখন তাই ভাবি! (চিত্র নং ১২)



চিত্র নং (১২). বক্সী পরিবারে পুণ্যার সময় ব্যবহৃত তারজালির অলংকরণ-যুক্ত একটি রুপোর গোলাপপাশ (গোলাপপাশ-টিতে সোনার জলের কাজ বর্তমান)।

প্রঃ: চলে আসি অন্য প্রসঙ্গে, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াচর্চায় আপনাদের পরিবারের কুচবিহারে বিশেষ সুনাম ও অবদান ছিলো, সেই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?

উঃ: যেটুকু শুনেছি এবং মনে আছে তা বলছি। শুনেছি বড় জ্যাঠামশাই বেহালা ও মেজো জ্যাঠামশাই ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন। (চিত্র নং ১৩) বাবা ভালো তবলা বাজাতে পারতেন।


চিত্র (১৩). নলিনীমোহন বক্সীর ব্যবহৃত ক্ল্যারিওনেট।

তিনি গানও শিখেছিলেন, হারমোনিয়ামে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন। বাবা সাধারণত ভজন ও কালীকীর্তন গাইতেন। মা খুব সুন্দর গান গাইতেন। ছোট থেকে তাঁকে গান গাইতে শুনেছি। তাঁর সঙ্গীতগুরু কে ছিলেন তা বলতে পারবো না। তিনি মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। এছাড়া অতুলপ্রসাদী গাইতেন। তিনি ক্ল্যাসিক্যাল গাইতেন না। দিদি (ꣲসুজাতা বক্সী) মুখ্যত ক্ল্যাসিক্যালের ছাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন, খুব ভালো গাইতেন। (চিত্র নং ১৪) তৎকালীন ভিক্টোরিয়া কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন স্বর্গীয় তারাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি সঙ্গীতে ওস্তাদ ছিলেন। তিনি বাবার গান ও তবলা এবং দিদির সঙ্গীত-গুরু ছিলেন।



চিত্র নং (১৪). গৌরী দেবী, সাথে কন্যা সুজাতা, আনুমানিক ১৯৪০ সাল নাগাদ গৃহীত।

বড় জ্যাঠামশাই নাটক করতেন বলে শুনেছি, কিন্তু তাঁর নাটক আমি দেখিনি। মেজো জ্যাঠামশাই 'মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ক্লাব'-এর সম্পাদক ছিলেন, তিনি নাটকে অভিনয় করতেন কিনা ঠিক বলতে পারছি না, তবে ক্লাবের নাটকে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করতেন। শুনেছি তিনি ভালো ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতেন। তিনি ভালো সাঁতারও জানতেন, সাঁতার প্রতিযোগিতায় একটি রুপোর কাপ পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলেন।

সেজো জ্যাঠামশাই ভালো বিলিয়ার্ডস খেলতেন। তিনি মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ক্লাবের সদস্য ছিলেন, সেখানে বিলিয়ার্ডস খেলেছেন।

বাবা খেলাধুলোয় বিশেষত টেনিসে খুব ভালো ছিলেন। তাঁর অনেক মেডেল ও কাপ ছিলো। রাজবাড়ির লনে মহারাজাদের সাথে টেনিস খেলতেন। তিনি কুচবিহারের 'কুচবিহার ক্লাব', 'মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ক্লাব' এবং সাউথ ক্লাবের ('ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব', ১৯৫৮ সালে নাম পরিবর্তিত হয়ে 'ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব লিঃ' হয়েছে) সদস্য ছিলেন। (চিত্র নং ১৫)



চিত্র নং (১৫). বক্সী ভাতৃগণ — ডান থেকে বা-দিকে — সুধাংশুমোহন, নলিনীমোহন, ললিতমোহন ও মোহিনীমোহন; (জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রমোহন অকালে গত হয়েছিলেন।) চিত্রটি আনুমানিক ১৯৪০ সালের প্রথমভাগে বক্সী বাড়ির মূল দালানের সামনে গৃহীত।

প্রঃ: শুনেছি আপনাদের বাড়িতে শিকারের চল ছিলো, কারা শিকার করতেন?

উঃ: হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। শিকারের সব থেকে বেশী শখ ছিলো মেজো জ্যাঠামশাইয়ের। বীরেন বাবু (ক্যাপ্টেন ꣲবীরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ), ছানা বাবু (ꣲদ্বিজেশচন্দ্র গুহ), মেঘা বাবু (ꣲভবেশচন্দ্র গুহ) তাঁর শিকারের সঙ্গী ছিলেন। এছাড়া সেজো জ্যাঠামশাইও শিকার করতেন। বাবা শিকারে যেতেন, সাধারণত মহারাজার (মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুর, ১৯২২-১৯৪৯ খ্রীঃ) সাথেই বেশীরভাগ সময় যেতেন, তবে শিকার তিনি খুব একটা পছন্দ করতেন না।

প্রঃ: এছাড়া বাড়িতে আর কারোর কোনো শখ ছিলো?

উঃ: বড় জ্যাঠামশাই ও বাবা দু'জনেরই ছবি তোলার শখ ছিলো। বড় জ্যাঠামশাইয়ের এই শখের বিষয়ে আমি আর তেমন কিছু বলতে পারবো না। বাবার বেশ কয়েকটি ক্যামেরা ছিলো, তার মধ্যে 'আগফা' ও 'ব্রাউনি', এই দুটির কথা আমার মনে আছে। বাড়িতে নিজেস্ব ডার্ক রূম ছিলো। ঘরটি ঠিক কোথায় ছিলো আমরা মনে নেই। সেখানে বাবা নিজেই তাঁর তোলা ছবি ডেভেলপ করতেন। মোটামুটিভাবে ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বাবা ছবি তুলেছেন। আমাদের প্রজন্মে ছোরদার (ꣲনলিনীমোহন বক্সী ও ꣲকমলা দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র ꣲদিলীপমোহন বক্সী) ছবি তোলার শখ ছিলো, তিনিও ওই ডার্ক রূমটি ব্যবহার করেছেন।

প্রঃ: আপনার বাবা কুচবিহার পৌরসভার সাথে সদস্য ও কমিশনার হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি একসময় কুচবিহার শহরের পৌরপতি হয়েছিলেন এবং কুচবিহারে ১৯৫১ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য-আন্দোলনের সময় পৌরপতি ছিলেন। আপনার সেই স্মৃতি কিছু মনে আছে? 

উঃ: বাবা দু'বার (একবার?) পৌরপতি হয়েছিলেন। সে সময় যাঁরা তাঁর পরিচিত গণ্য-মান্য ব্যক্তি ছিলেন, যেমন, কুতলু বাবু (ꣲনগেন্দ্রলাল রায়), সুশীল বাবু (সুশীলচন্দ্র গুহ), ফণী বাবু (ক্যাপ্টেন ꣲপূর্ণানন্দ রায়) তাঁরা বাবাকে পৌর-নির্বাচনে (সম্ভবত, পৌরপতি হিসেবে নির্বাচনের সময় নয়, অন্য কোনো পৌর-নির্বাচনে!) দাঁড়াতে বলেছিলেন।
মনে পড়ে অন্ততঃ একবার নির্বাচনের প্ল্যাকার্ড পড়েছিল। (এই প্রসঙ্গে অন্য একটি কথা বললেন — ) বাবা-দের যাঁরা বন্ধুস্থানীয় ছিলেন তাঁদের পরস্পরের বয়স কিছু কম-বেশী হলেও তাঁরা একে-অপরকে 'তুই' বা 'তুমি' বলেই সম্বোধন করতেন। 'আপনির' চল ছিলো না। ফণী বাবু একজন ভক্ত মানুষ ছিলেন।

ঠিকই, কুচবিহারে ১৯৫১ সালের খাদ্য-আন্দোলনের সময় বাবা পৌরপতি ছিলেন। আন্দোলনের বিষয়টির সাথে তাঁর সংস্রব ছিলো, কিন্তু বিস্তারিত কিছু এখন আর মনে নেই। শুধুমাত্র এটুকু মনে পড়ে বাড়ি থেকে দাদা-দের সাথে শহীদদের দেখতে গিয়েছিলুম।

প্রঃ: আপনার পিসেমশাই, পণ্ডিতবর বিশিষ্ট লেখক স্বর্গীয় শরৎচন্দ্র ঘোষাল (সিভিল অ্যান্ড সেশন্স জজ, কুচবিহার, কোচবিহার দর্পণ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক, বিশিষ্ট সেতার-বাদক ও বীণকর) যিনি খাঁ  চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ সংকলিত কোচবিহারের ইতিহাস ইংরেজীতে তর্জমা করেছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে আপনার কিছু মনে আছে?

উঃ: হ্যাঁ, আমাদের বড় পিসেমশাই। তাঁর সাথে আমাদের বড় পিসিমা স্বর্গীয়া লীলাবতী দেবীর (মৃত্যু: ২৪ এপ্রিল, ১৯৩৮, রবিবার) বিবাহ হয়েছিল। বড় পিসেমশাইকে যখন দেখেছি তখন আমার বড়জোর চার-পাঁচ বছর বয়স। তিনি সুনীতি রোডের উত্তরদিকে ꣲভবানীপ্রসন্ন তালুকদার-এর বাড়িতে (অধুনালুপ্ত) ভাড়া থাকতেন। ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন এরকম একটি দৃশ্য স্মৃতিতে ভেসে ওঠে।  তাঁদের আট ছেলেমেয়ে ছিলো (স: সাত জন সন্তান ছিলো, তিন পুত্র, — ꣲঅরুণ, ꣲঅনিল, ꣲমন্টু ও চার কন্যা), দুই ছেলে অরুণ দা আর গাগু (ꣲঅনিল) দা-র কথা আমার মনে আছে। তাঁরা দু'জনেই আমার থেকে বয়সে অনেক বড় ছিলেন।

প্রঃ: কুচবিহারের মাটির সাথে আপনাদের এরকম নিবিড় সংযোগ, কুচবিহারের ইতিহাসে আপনাদের পরিবারের এতো প্রসিদ্ধি, তবু আপনাদের পরিবারের সকলে কেন কুচবিহার ছেড়ে চলে গেলেন? 

উঃ: দেশভাগ ও মার্জারের পর তাঁদের ধারণা হয়েছিল তাঁদের যা প্রাপ্য সম্মান তাঁরা তা পেতেন না। নইলে কুচবিহার ছেড়ে আসবার মতো জায়গা নয়। খুব সুন্দর জায়গা। কুচবিহার আমার জন্মভূমি। আমাদের সেখানে সবই ছিলো। কুচবিহার ছেড়ে আসবার পর বাবা সিঁথির
কালীচরণ ঘোষ রোডে বাড়ি করেছিলেন। কলকাতায় আসবার পর বাবার জীবনের অধিকাংশ সময় মঠ-মিশনের (রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন) সংস্রবেই কেটেছিল।

প্রঃ: আচ্ছা, আপনাদের পরিবারের সাথে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বহুকালের যোগাযোগ। আপনার বড় জ্যাঠামশাই এবং আপনার বাবা দু'জনে কুচবিহারে 'শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম' (বর্তমানে 'রামকৃষ্ণ মঠ, কোচবিহার') প্রতিষ্ঠার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। শুনেছি পূজনীয় শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজজী (রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বাদশতম সংঘাধ্যক্ষ) আপনাদের বাড়িতে এসেছিলেন, সেই স্মৃতি আপনার কিছু মনে আছে?

উঃ: অল্প-সল্প মনে আছে। সম্ভবত, ১৯৪৪ সাল নাগাদ পূজনীয় ভূতেশানন্দ মহারাজজী আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। মনে পড়ে বাড়িতে থাকাকালীন মহারাজ সন্ধ্যাবেলা শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে পাঠ করতেন। কখনও সাধুদের ঘরে কখনও বা ঠাকুর ঘরে(২), যেখানে ঠাকুর-মা-স্বামীজী ছিলেন সেখানে পাঠ হতো। আমার সে পাঠ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, কিন্তু তখনও সে পাঠ বোঝবার মতো বয়স হয়নি। 

প্রঃ: তিনি কোন ঘরটিতে ছিলেন? 

উঃ: বাড়ির ভেতরে উঠোনের দক্ষিণ-পূর্বদিকে আমাদের যে পড়ার ঘরটি ছিলো, সেটি মূল দালান থেকে একটু দূরে ছিলো। পরবর্তীতে ওই ঘরটিতে বাবা সাধু-মহারাজদের থাকবার ব্যবস্থা করেছিলেন। যাতে তাঁদের সেখানে থাকতে কোনো রকম অসুবিধে না হয় ঘরটিকে গৃহস্থালী থেকে একদম আলাদা রাখা হয়েছিল। সাধু-মহারাজরা এলে সেখানে থাকতেন। অন্য সময় ঘরটিকে বন্ধ করে রাখা হতো, কেউ আর ব্যবহার করতেন না। মহারাজ ওই ঘরটিতে থেকে ছিলেন। ঘরটিকে 'সাধুদের ঘর' বলা হতো।

প্রঃ: পূজণীয় মহারাজজীর সাথে আপনার কোনো স্মৃতি আছে?

উঃ: হ্যাঁ, একটি ঘটনা বিশেষভাবে মনে পড়ে। তবে সেটি অনেক পরের ব্যাপার।

প্রঃ: কি রকম ঘটনা?

উঃ: একবার ঠাকুরের তিথিপুজোর সময় পূজণীয় মহারাজজী কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আসবেন। গাড়ী নিয়ে গিয়েছি মহারাজকে নিয়ে আসতে। মহারাজ তখনও মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট হ'ননি, সম্ভবত তখন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। বেলুড় মঠে এখন যেখানে জুতোঘরটি হয়েছে, তার পেছনদিকের হলদে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন। সেখানে গেলে ভক্তরা তাঁকে দর্শন ও প্রণাম করবার সুযোগ পেতেন। আমি গিয়ে মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে তাঁকে গাড়ীতে করে পুরনো বালি ব্রীজ দিয়ে আসছি। মহারাজের পাছে কষ্ট হয়, তাই গাড়ী খুব আস্তে আস্তে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় গাড়ীর ওই রকম গতি দেখে মহারাজ আমায় বললেন — "তুই কি গরুর গাড়ী চালাচ্ছিস" শুনে আমি সামান্য গতি বাড়িয়ে দিলুম। এতোটাই সামান্য যে মহারাজ আবার বললেন — "এটা যন্ত্র, গরুর গাড়ী নয়, এটাকে যন্ত্রের মতো চালিয়ে এর সার্থক ব্যবহার করো"। মহারাজের কণ্ঠস্বর অদ্ভুত মিষ্টি ছিলো। আমি গাড়ীর গতি আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিলুম বটে, তবু সেদিন ধীরে ধীরে চালিয়ে পৌঁছে ছিলুম।

প্রঃ: কুচবিহারে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম প্রতিষ্ঠার আগে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পূজনীয় হরেন্দ্র নারায়ণ ব্রহ্মচারী মহারাজজী আপনাদের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন, সে বিষয়ে কিছু মনে আছে? 

উঃ: দেশভাগের সময় পূজনীয় মহারাজজী পূর্ববঙ্গ থেকে কুচবিহারে এলে পর বাবা তাঁর সেবার জন্য তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৪৭ সাল 
নাগাদ বাড়িতে এসে তিনি প্রথমে আমাদের কাছারি বাড়িতে উঠেছিলেন, পরবর্তীতে ওই উঠোনের ঘরটিতে ছিলেন। সাধুরা এলে পর মায়েরা (বাড়ির মহিলারা) সকলে মিলে তাঁদের আহারাদি সাজিয়ে দিতেন, কিন্তু নিয়ে যেতেন বাবা। মায়েরা দূর থেকে লক্ষ্য রাখতেন। সাধুদের আহারের সময় বাবা তাঁদের কাছে বসে সেবা করতেন।

প্রঃ: পূজনীয় হরেন্দ্র নারায়ণ ব্রহ্মচারী মহারাজজী আপনাদের বাড়িতে থাকাকালীন কি পাঠ হতো?

উঃ: ঠিক মনে নেই। (চিত্র নং ১৬-১৭)


চিত্র নং (১৬). কুচবিহার রামকৃষ্ণ আশ্রম মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পট প্রতিষ্ঠার শোভাযাত্রার আলোকচিত্র; আনুমানিক ১৯৫০-এর দশক।



চিত্র নং (১৭). কুচবিহার রামকৃষ্ণ আশ্রম মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, শ্রীমা সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দ-র পট প্রতিষ্ঠার শোভা যাত্রা; সামনের দিকে হাতে ঘট নিয়ে সুধাংশুমোহন বক্সী; আনুমানিক ১৯৫০-এর দশক

প্রঃ: তাহলে আপনি ছোট থেকে অনেক সাধু-মহারাজদের দেখবার সুযোগ পেয়েছেন?   

উঃ: কি আর বলি! ঈশ্বরেচ্ছায় সেই সৌভাগ্য হয়েছে বলে পেয়েছি।

প্রঃ: আপনার ছোটবেলার আর এরকম কোনো ঘটনা মনে আছে?

উঃ: হ্যাঁ, যদিও সেটি কুচবিহারের সাথে সরাসরি সম্বন্ধিত নয়।

প্রঃ: ঘটনাটি যদি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতেন?

উঃ: বাবার সাথে ছোটবেলা থেকে বেলুড় মঠে যেতুম। বাবা-মা দু'জনে ছিলেন পূজণীয় শ্রীমৎ স্বামী বিরজানন্দ মহারাজজীর (রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষষ্ঠ সংঘাধ্যক্ষ) আশ্রিত। বড় জ্যাঠামশাই ও বড় জেঠিমা-ও (ꣲপূর্ণিমা দেবী) তাঁর কাছে দীক্ষা পেয়েছিলেন। একবার মঠে গিয়েছি, তখন পাঁচ-ছয় বছর বয়স (১৯৪৫-১৯৪৬ সাল)। মহারাজ তখন মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট। তিনি দোতলায় স্বামীজীর ঘরের পাশের ঘরটিতে থাকতেন। বাবার সাথে ভেতরদিকের পুরনো সিঁড়ি দিয়ে উঠে তাঁর ঘরে গিয়েছি। ঘরে সেদিন অনাদি মহারাজ উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট মহারাজের দর্শনপ্রার্থী হয়ে সেদিন অনেক ভক্ত এসেছেন। ভিড়ের মাঝ থেকে তিনি আমায় ডেকে নিলেন। তাঁকে প্রণাম করলাম। প্রেসিডেন্ট মহারাজ ব্রহ্মচারী সত্যকৃষ্ণ মহারাজকে (পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পঞ্চদশতম সংঘাধ্যক্ষ, পূজণীয় শ্রীমৎ স্বামী আত্মস্থানন্দ মহারাজজী) জিজ্ঞেস করলেন — "সত্যকৃষ্ণ, ওঁকে কিছু দিয়েছো?"। সত্যকৃষ্ণ মহারাজ একটি জালি দেওয়া কাঠের মিডসেফ থেকে প্রসাদী সন্দেশ বের করে, একটি তাল পাকিয়ে সাদা রঙের প্যাকেটে ভরে নিলেন। এরপর আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামিয়ে উঠোনে স্বামীজীর লাগানো আমগাছের নীচে বসতে দিলেন এবং প্যাকেটটি আমার হাতে দিয়ে বললেন — "বসে রইলি কেন? খেয়ে নে, কল (মঠের রান্নাঘরে) থেকে জল খেয়ে নিবি"। জ্ঞান মহারাজও স্বামীজীর আবাসটির নীচ তলায় তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে বললেন — "কিরে ব্যাটা বসে আছিস কেন, খেয়ে নে।" সাধুদের বলা সেও তো আশীর্বাদ!

প্রঃ: আপনার দাদুর পরিবারের সাথে কি মঠের কোনো সংযোগ ছিলো?

উঃ: হ্যাঁ, ছিলো।

প্রঃ: কি রকম সংযোগ ছিলো? 

উঃ: মা ছোট থাকতে তাঁর ঠাকুরদার সাথে বেলুড় মঠে যেতেন। মায়ের ঠাকুরদা পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজজীর (পূজনীয় শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ মহারাজজী, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম পার্ষদ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় সংঘাধ্যক্ষ) আশ্রিত ছিলেন, তাঁকে মহারাজ খুব ভালোবাসতেন। মায়ের মহাপুরুষ মহারাজকে দর্শন করবার সৌভাগ্য হয়েছিল। মায়ের কাছে শোনা মহারাজ সম্বন্ধে ক'টি গল্প মনে পড়ে।

প্রঃ: গল্পগুলি শোনা যাবে?

উঃ: নিশ্চয়ই। এই প্রসঙ্গ এলে আর অন্য কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এসব আলোচনার পর অন্য কিছু বলবারও বাকি থাকে না।

মায়ের কাছে যেমনটি শুনেছি বলতে চেষ্টা করছি। একবার মহাপুরুষ মহারাজ এক ব্রহ্মচারীকে জিজ্ঞেস করছেন — "আজ যখন গঙ্গায় জোয়ার এসেছিল মঠের (গঙ্গার ঘাটের) ক'টা সিঁড়ি ডুবেছিল?" ব্রহ্মচারী বললেন — "মহারাজ সেটা তো খেয়াল করিনি!" মহারাজ আবার জিজ্ঞেস করলেন, — "আচ্ছা, মঠের গোয়ালে একটি বাছুর জন্মেছে, সেটি এড়ে না বকনা?" সেবারও ব্রহ্মচারী উত্তর দিতে পারলেন না। এই দেখে মহারাজ বললেন, — "ঠাকুরের নিবাসে তাঁর আশ্রয়ে আছিস ঠাকুরের বাড়ির খবরাখবর রাখবি না?" এই বলে মহারাজ নিজে উত্তরগুলি এমনকি সদ্যোজাত বাছুরের রঙ পর্যন্ত বলে দিয়েছিলেন। 

আরও একবার মহারাজ এক ব্রহ্মচারীকে জিজ্ঞেস করছেন, — "আজ কি পড়লি?" ব্রহ্মচারী উত্তর দিলেন, — "মহারাজ, আজ গীতা পড়ে শেষ করলুম।" মহারাজ এই উত্তর শুনে বলেছিলেন, — "সেকি! বল আজ থেকে গীতা পড়া শুরু করলুম।"


চিত্র নং (১৮). রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পূজনীয় শ্রীমৎ বাগেশানন্দ জী মহারাজ (ছবির কেন্দ্রে উপবিষ্ট), অন্যান্য সাধুবৃন্দ ও ভক্ত মন্ডলীর সাথে সুধাংশুমোহন বক্সী (হাতে করে কিছু একটি নিবেদনরত); ছবির ওপরের সারিতে বা থেকে ডান-দিকে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় শ্যামাদাস বক্সী; ছবিটি আনুমানিক ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে সম্ভবত কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গৃহীত।
__________________________________________

(১). বক্সী পরিবারের কুলবিগ্রহ ꣲশ্রীꣲশ্রী দয়াময়ী এবং ꣲশ্রীꣲশ্রী শ্যামসুন্দর ও ꣲশ্রীꣲশ্রী মনোমোহিনী (শ্রীরাধিকা) বর্তমানে কুচবিহারের ব্রহ্মচারী কালীবাড়িতে স্থাপিত। এই প্রসঙ্গে শ্যামাদাস বাবু বলেছিলেন — "দেশভাগের সময় নাওডাঙ্গা থেকে আমাদের কুলবিগ্রহ দয়াময়ী এবং শ্যামসুন্দর-কে সেজো জ্যাঠামশাই (ꣲমোহিনীমোহন বক্সী) কুচবিহারে নিয়ে এসেছিলেন "

নাওডাঙ্গায় দেবী দয়াময়ী-র বিগ্রহ একটি বড় পেতলের সিংহাসনের ভেতর রুপোর ছোট সিংহাসনে স্থাপন করা ছিলো। সিংহাসন দুটি মন্দিরে এখনও বর্তমান। শ্যামসুন্দর ও মনোমোহিনী অনেক-ক'টি নারায়ণ শিলা-সহ একটি কাঠের বড় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। [ — ভট্টাচার্য মিনতি, হালতু-পূর্বাচল, (জন্ম: ২৯ এপ্রিল, ১৯৩৫, রবিবার, কুচবিহার), সাক্ষাৎকার: ২০, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১।]

(২). বাড়িতে পুজো-অর্চনা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে পুজো ও পুজোঘরটির সম্বন্ধে শ্যামাদাস বাবু বলেছিলেন — "আমাদের ভেতরের বারান্দার পশ্চিমদিকে ওই বারান্দা-সংলগ্ন একটি ঠাকুরঘর ছিলো। বাবা পুজো-অর্চনা করতে ভালোবাসতেন। সেখানে ঠাকুর-মা-স্বামীজী-র (শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, শ্রীশ্রী সারদা দেবী ও শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ) পটে নিত্য পুজো হতো।"

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্রীমতী ꣲজয়ন্তী চক্রবর্তী, শ্রী ꣲতাপসমোহন বক্সী, শ্রীমতী সবিতা বক্সী, শ্রীমতী মিনতি ভট্টাচার্য, শ্রীমতী প্রণতী চক্রবর্তী, শ্রীমতী চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী বীরেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, 
শ্রীমতী কাকলি রায় চৌধুরী, শ্রী জয় ব্যানার্জী, শ্রী স্নেহাশিষ দত্ত চৌধুরী, শ্রী বোধিসত্ত্ব সেনগুপ্ত। 

[বিঃ দ্রঃ: ২০১৭ সাল থেকে সাক্ষাৎকার নোট করা ও প্রশ্ন তৈরী করা শুরু হয়েছিল। ৩১ আগস্ট, ২০১৮ থেকে ৩১ জানুয়ারী, ২০২১ পর্যন্ত সাক্ষাৎকারটি অডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে।]

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন