ভৌতিক

সৌমিলি বোস 


প্রতিদিনের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু অদ্ভুত সত্য আমরা তাৎক্ষণিকভাবে খুব সুন্দর করে মেনে নিই।কোনো কারণ খুঁজতে যাই না, অথবা অকারণ যুক্তিবিন্যাসে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে নিই। পরে কোনো অদূর ভবিষ্যতে একা রাতে পাশ বালিশ আঁকড়ে এই স্মৃতির কথা মনে পড়লে শরীরটা অজান্তেই ছ্যাঁৎ করে মনে ওঠে। মনে হয়, সাধারণত স্বতঃসিদ্ধ যুক্তির বাইরে গিয়ে কি করে ঘটতে পারে একটা সম্পূর্ণ বাস্তববিচ্ছিন্ন ঘটনা? 


কিন্তু প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। প্রতি ন্যানো সেকেন্ডে আমাদের চারপাশে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যার কোনো সদর্থক কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। অনেক থিয়োরি এক জায়গায় জড়ো করে হয়তো কিছু ব্যাখা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, তবে সেগুলো নিতান্তই মনের সান্ত্বনা, নিজেকে জোর করে বোঝানো!আসলে ভূত আর ভবিষ্যত এই শব্দদুটো চিরকালই ভীষণ ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। কিন্তু আমরা ছন্দ মেলাতে ভূতের সাথে প্রেত শব্দটা চমৎকার মিলিয়ে দিয়েছি! 

কত্ত ভূত বাব্বা!! 

কিম্ভূত! অদ্ভুত! মা ভূত! বাবা ভূত! 

কিন্তু সত্যি বলতে ভূতের সাথে আমার একবার বেশ রসালো একটা বন্ধুত্ব ও হয়েছিল। খুব মাখো মাখো কেস! 

তবে আর বলছি কি! 

সেবার আমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সদ্য সদ্য বাইরে টিউশন পড়তে যাওয়া আরম্ভ করেছি।বয়সটা ষোলো পেরিয়ে সতেরোর ঘর ছুঁই ছুঁই করছে, আলাদাই মেজাজ। 

মনের মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতি গুলো অজান্তেই দলা পাকাতে শুরু করেছে। নানারকম জিনিসের উপর প্রচন্ড অনাবশ্যক কৌতূহল, আসলে এই বয়সে যা হয় আর কি! 


তো কিছুদিন পর যা হবার হয়েই গেল। আমি প্রেমে পড়লাম। নতুন নতুন স্মার্টফোন পেয়েছি। সেটার সদ্ব্যবহার না করলে চলে নাকি! 


ছেলেটার সাথে আমার বয়সের বিস্তর ফারাক ছিল।মুখটা এখনও পর্যন্ত যতদূর মনে পড়ে,অনেকটা ভাতের হাড়ির পিছনদিকটার মতো। তো তাকে আমি তখন কিছুদিনের জন্য আমার দুনিয়া বানিয়ে নিলাম। আই মিন, তুমিই একমাত্র, বাকি সব ভার মে যা। এরকম ব্যাপার। সেই ব্যক্তি আমায় যা বলতো আমি দুটো গাল ফুলিয়ে হি হি করে হেসে তাই ই করতাম। আর মনে মনে ভাবতাম, আহা ঠিক 'হাম দিল দে চুকে সানাম' এর সালমন খানকে পেয়েছি গো। ফুর্তি আর ধরে কোথায়! প্রেম তখন গা হাত পা বেয়ে মাথায় উঠে বসেছে। 

এই রে, কথায় কথায় সেই মহাপুরুষের নামটাই বলতে ভুলে গেছি। শ্রীমান টেঁকচাদ!! 

আরে না না, এটা ওর আসল নাম নয়, এই নামে আমি ন্যাকামো মেরে ডাকতাম। তার নাম মি. সৌর্যদ্যুতি চক্কোত্তি। 

কিন্তু একটাই প্রবলেম ছিল ওর।আমার সামনে কখনো চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতো না। আমার মাঝে মাঝে খুব বিকট লাগতো। বেশি রাগ ও দেখাতে পারতাম না। ও মা গো, তারপর যদি রেগেমেগে আমার সলমন খান আমার সাথে ব্রেকআপ করে দেয়? 

ওর অনেক ছবি আমার গ্যালারি তে সেভ করা ছিল। মাঝে মাঝে জুম করে করে দেখতাম আর হারিয়ে যেতাম। মনে হত সর্ষে খেতের মধ্যিখানে আমি ওড়না নিয়ে দৌড়াচ্ছি। আর নায়ক গান করছে, "তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম.... "


"এই মেয়েটা,গুনগুন করে কি বলছিস রে? পড়াশোনার নাম নেই, খালি সারাদিন ধরে ফোন নিয়ে বসে থাকিস। আসুক আজকে তোর বাবা বাড়িতে! "


ব্যস, এখানেই মা আমার দিবাস্বপ্নের ইতি টেনে দিত। অগত্যা, সেই সময়কার মতো প্রেমিকের প্রতীক্ষায় বুকে পাথরের টুকরো চাপিয়ে রাখো। আমার একটামাত্ত বাবু, সোনা, জানু,পুচু বলে কথা! 


তো এবার আসি একটু ঘুরুঘুরুর কথায়। প্রেম যখন করছি, মাঝেমধ্যে তো একটু এদিক ওদিক ডুব মারবোই টিউশনের নাম করে, আমি অবশ্য স্কুল বাঙ্ক ও মেরেছি বহুবার। আর আমার গুণধর প্রেমিক বরাবরই আমাকে আশ্বাস জুগিয়েছে, "ভেঙে পড়বে না সোনা, তুমি সব পারবে দেখো। অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি সব আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেবো। ইলেভেনের সিলেবাস আমার কন্ঠস্থ।"

আর আমিও পোলট্রির মুরগির মতো কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়েছি ওর দিকে, আহা! কি ভালোই না বাসে আমাকে। মা-বাবা তো তুচ্ছ! এই তো ভগবান! 


সেদিন আমরা একটু দূরেই ঘুরতে গেছিলাম। বাইকে স্টার্ট দিলে আবার তেনার মাথার ঠিক থাকতো না। বাইক চলছে তো চলছেই। আমার খুব ইচ্ছা করছিল গলা ছেড়ে গাইতে, এই পথ যদি না শেষ হয়! তবে কেমন হতো, তুমি বলোতো! 

কিন্তু না, সেদিন আমি বা ও কেউই বলার সুযোগ পাইনি। নিমেষে একটা ট্রাকের নীচে পড়ে পিষে যায় বাইকটা।আমি ছিটকে পড়ি অনেকটা দূরে। এই টুকু পর্যন্ত আমার নিজের চোখে দেখা। তারপর সব অন্ধকার। 

জ্ঞান আসার পর জানতে পারি, আমাকে নাকি একটা বিশাল ট্রাক ধাক্কা মারতে যাচ্ছিল। জনৈক পথযাত্রীর সৌজন্যে আমি বেঁচে গেছি। আমার আশেপাশে বাইকের কোনো চিহ্নমাত্রও পাওয়া যায়নি, না পাওয়া গেছে কোনো ছেলের দেহ। আমি বারংবার পুলিশকে বলা সত্ত্বেও কেউ বিশ্বাস করে না আমার কথা। ভাবে, ওষুধের অতিরিক্ত ডোজে আমি ভুলভাল বকছি। 

তবে ঘটনাস্থল থেকে একটা জেন্টস সানগ্লাস পাওয়া গেছিল, ওটা পোস্টমর্টেম করা হয়, তারমধ্যে একটা চুল পাওয়া যায়, যেটা ছয়মাসের মৃত একটা লাশের বলে শনাক্ত করা হয়। সানগ্লাস টা আমি আর ফেরত পায়নি। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম দু সপ্তাহ পর। তারপর অসংখ্য বার সৌর্যদ্যুতির ফোনে ট্রাই করেছি। 

"আপনি যে নম্বরে কল করেছেন, সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই, দয়া করে পুনরায় চেষ্টা করুন বা কিছুক্ষণ পর আবার কল করুন।"

একসময় এই কথা শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠলাম আমি। তারপর আর কোনোদিন ওই নম্বরে চেষ্টা করিনি।। 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন